ঠিক এক বছর আগে ২০১৯ সনের জানুয়ারিতে বাক্-এর
একটি সম্পূর্ণ সংখ্যা নিবেদিত হয়েছিল ছোটগল্পে। ঘটনাচক্রে এক বছর পরে জানুয়ারিতেই আরও
একটি গল্পসংখ্যার মাধ্যমে শীতঘুম কাটিয়ে ফিরে এল বাক্। সাদৃশ্যের ইতি অবশ্য এখানেই নয়। বিগত গল্পসংখ্যাটি প্রকাশিত
হয় ১২ জানুয়ারি। আপামর ভারতবাসীর জীবনেই আজও দিনটির এক অন্যতর তাৎপর্য আছে বলেই
মনে হয়। ঘটনাচক্রে বাক্ ১৩৯ প্রকাশিত হচ্ছে ২৬ জানুয়ারি। গ্রেগরিয়ান
ক্যালেন্ডারের প্রথম পাতাটি ভারতবাসীকে উপহার দেয় তিন-তিনটি পুণ্যদিবস— স্বামী
বিবেকানন্দ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মাপের দুই যুগপুরুষের আবির্ভাব তিথির
পিঠোপিঠিই এসে পড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস। ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে কি বৈদ্যুতিন
মাধ্যমের বাঙালি পাঠকের জন্য আরও একটি গল্পসংখ্যা নিয়ে আসবে বাক্? সময়ই দেবে এই
প্রশ্নের উত্তর।
সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে সর্বত্রই। পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবরাশি প্রাকৃতিক জগতে। সাহিত্যের ফর্মও ব্যতিক্রম নয়। এবং এক্ষেত্রে বিবর্তনের কারসাজির
হদিস করলে দেখা যায় কবিতাই সেই আদিম এককোষী অস্তিত্ব যার মারফত উন্মেষ ঘটেছিল
সাহিত্যের। উপন্যাস নবীনতর। এবং ছোটগল্প
একেবারেই নবীনতম এই তিন সৃষ্টিশীল ফর্মের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের আগে
বাংলা উপন্যাস ছিল। কিন্তু বাংলা ছোটগল্পের অস্তিত্ব ছিল না। সমালোচকের চুলচেরা
বিশ্লেষণে হয়তো বলা যাবে অন্যতর কোনও অনামি বাঙালি লেখকের কলমে রবীন্দ্রনাথের
পূর্বাহ্নেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বাংলার প্রথম সার্থক ছোটগল্পটি। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক
ঘটনাটিও ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমকালেই। বাংলা কবিতার প্রথম ব্লগজিন বাক্-এর
সূচনা থেকে যাবতীয় সংখ্যাগুলির দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে বিবর্তনের উক্ত ঐতিহ্যটি
এই পত্রিকার বেলাতেও অনুসৃত হয়েছে অবিকল। কবিতার মাধ্যমে পথ-চলা শুরু করে এই
ব্লগজিন ক্রমশ মনোযোগী হয়েছে ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রকাশনায়। একশোতম সংখ্যার
অব্যবহিত পরে ব্লগজিনের পাতায় স্থান পেয়েছে ছোটগল্প। ১৩৯ সংখ্যার হিসেব মাথায়
রাখলে খুব বেশিদিনের কথা নয়।
ছোটগল্প
নিয়ে এতগুলো কথা বলার দরকার পড়ল কেন? দরকার পড়ল, নেপথ্যে থেকে যাওয়া একটি গূঢ় প্রশ্নের
সূত্রে। স্রেফ ছোটগল্পকারের পরিচয়ে বাংলা সাহিত্যে কি প্রতিষ্ঠালাভ সম্ভব? আমরা
এখনও পাইনি কোনও ইতিবাচক উত্তর। কবি
পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আপনাকে উপন্যাসে মাথা ঘামাতে হবে না, নিবন্ধে হাত পাকাতে
হবে না, শুধু কবিতা লিখেই আজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন আপনি। শুধু ঔপন্যাসিকের পরিচয়ে
প্রতিষ্ঠালাভ তো বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজ আর কোনও ঘটনাই নয়। মোটেই জরুরি নয় ছোটগল্প রচনা। প্রশ্নই উঠবে না কবিতা লেখেন নাকি। রবীন্দ্র-পূর্ব
যুগের একজন কথাসাহিত্যিকও রচনা করেননি ছোটগল্প। অনুরূপ নিছক নাট্যকারের পরিচয়ে, নিছক প্রাবন্ধিকের পরিচয়ে, এমনকি নিছক
গীতিকারের পরিচয়েও (অল্পদিন আগেই সাহিত্যের নোবেল সম্মান প্রদান করা হয়েছে জনৈক
গীতিকারকে) প্রতিষ্ঠা পেতে সমর্থ হয়েছেন বাঙালি সাহিত্যিক। আজ অবধি একমাত্র
ব্যতিক্রম ছোটগল্পের ধারাতেই। ছোটগল্পকার
হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়তালাভ বা ছোটগল্প সংকলনের সুবাদেই পুরস্কৃত হওয়ার মতো
দৃষ্টান্ত অবশ্যই আছে। কিন্তু তার অর্থ কোনওমতেই এমন নয় যে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যিক
আজীবনে মনোযোগী হননি উপন্যাস রচনায়।
ছোটগল্পের অবিসংবাদিত রাজা হয়েও অজস্র উপন্যাস রচনা করেছেন বিমল কর। অতীন
বন্দ্যোপাধ্যায় তো কেন পুরস্কৃত হলেন না অমন মরমি উপন্যাসগুলির সুবাদে সেই প্রশ্নই
তোলেন অনেকে। তাহলে কি ধরে নেব, ফর্ম হিসেবে ছোটগল্প আজও স্বয়ম্ভু নয়? স্রেফ
উপন্যাসের হাত মকশো করার জন্যই এই ধারাটির অবতারণা? আজীবনে একটিও উপন্যাস না লিখেও
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অমর কথাসাহিত্যিকের শিরোপালাভ কি সত্যিই অবাস্তব?
এই
প্রশ্নগুলির উত্তর হয়তো এখনই পাওয়া যাবে না। তবে সন্ধানটুকু জরুরি। বাক্-এর
বর্তমান সংখ্যাটিকে তাই সাজানো হল বিভিন্ন স্বাদের পাঁচটি ছোটগল্পে। সমকালের
হাজারো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারা কীভাবে ছাপ ফেলছে জনৈক স্রষ্টা, জনৈক শিল্পী, তথা
জনৈক ছোটগল্পশিল্পীর মননে, জীবনের বিচিত্রতর আঙ্গিক থেকে তার প্রকাশ ঘটুক এক-একটি
গল্পে, সেটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। পাঁচ জাতের শৈলীতে সেই একই মধ্যবিত্তয়ানার
ক্রাইসিসের ঘুরেফিরে আসার ক্লান্তি যাতে গ্রাস না করে পাঠককে সেদিকেও সমান মনোযোগ
রাখার চেষ্টা করেছি আমরা। ফর্মকে মাথায় তুলে নাচতে গিয়ে কনটেন্টকে হেলাফেলা কাম্য
ছিল না যেহেতু। বিষয়কে গুরুত্বদানের প্রেক্ষিত থেকেই একেবারে কবিতাহীন রাখা হল না
এই সংখ্যাকে। তবে মৌলিক নয়, জার্মান-আমেরিকান সাহিত্যিক চার্লস বুকোওস্কির একগুচ্ছ
কবিতার অনুবাদ স্থান পেল এই সংখ্যায়। যে সমকালে অস্তিত্বশীল হয়ে চলেছি আমরা, সিকি
শতাব্দী অতীতে প্রয়াত এক বিদেশি সাহিত্যিকের কবিতাভাবনা কীভাবে ইন্টারপ্রেট করে
সেই সময়কে, তাকে এই সংখ্যাতেই পাঠকের সামনে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করা গেল না। বুকোওস্কির কবিতার মধ্যে গল্পের এক ভূমিকা থেকেই যায়। তাঁর কিছু কবিতাকে স্বল্পায়তন ছোটগল্প হিসাবেও পড়তে পারেন পাঠক। তাছাড়া,
এক দশকেরও বেশি আগে ব্লগজিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল তো কবিতার মাধ্যমেই। আর থাকল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষের গল্প-সিনেমা 'হীরের আংটি'-র একটি আলোচনা। এই সংখ্যা সব মিলিয়ে গল্প দিয়েই সাজানো হল।
আবেশ কুমার দাস
বিভাগীয় সম্পাদক, ছোটগল্প,
বাক্ অনলাইন