বাক্‌ ১৩৯ ।। টিলার ওপারে ।। মানস সরকার



টিলার ওপারে

ওঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় ধ্রুববিকাশ মজুমদারের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে। সিলভার জুবিলি। মৃদুকণ্ঠে সলজ্জ ভঙ্গিতে উনি ফোনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শুনে, মেঘনা জলের বোতল ভরতে ভরতে বলল— যত্তসব ঢঙ!
         বলেছিলাম— কী এমন বয়েস! মাত্র সাতান্ন।
—আহা! তা বলে বিবাহবার্ষিকীতে মদ খাওয়ার নিমন্ত্রণ!
         —না-না, তা কেন? ড্রিঙ্কসের কথা তো উনি বলেননি। শুধু বলছেন পার্টি দিচ্ছেন।
যাব না-যাব না করেও মেঘনা শেষ পর্যন্ত গেল।
ইনডোর প্ল্যান্ট আর ডিভিডিতে সেতারের মৃদু ঝংকারে ধ্রুববিকাশবাবুর চব্বিশশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আবেশঘন হয়ে উঠেছে। কালো ট্রাউজার্সের ওপর অফ হোয়াইট ব্লেজার পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন।
নীল কাঞ্জিভরমে ম্যাডাম একান্ন বছর বয়সটাকে অনেকটা নীচে নামিয়ে এনেছেন। পায়ে পেনসিল হিলের মৃদু শব্দ তুলে ব্রাউন-ম্যাট লিপিস্টিকের ফাঁকে অল্প হাসির ঝলকে সকলের হাত থেকে গিফটপ্যাকগুলো নিয়ে পাশের রুমে বিছানার ওপর রাখছিলেন।
কফির চাপে চুমুকের মধ্যেই ধ্রুববিকাশবাবু সকলের হাতে তাঁর চোদ্দোতম উপন্যাসটি তুলে দিলেন। সকলেই জানতে চাইলাম, পনেরোতম উপন্যাসটি কি পরের বিবাহ বার্ষিকীতে প্রকাশিত হবে?
কথার উত্তরে তিনি সেই সলজ্জ হাসিটিই হেসেছিলেন।
প্রথম জানুয়ারির তীব্র ঠান্ডায় হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে পরিচয় হল কোয়েল লাহিড়ি, অভিষেক শতপথী, প্রান্তিক দেবরায়, দিঘি আচার্য এবং বিনায়ক সান্যালের সঙ্গে। তাঁদের নাম কখনও শুনিনি। তাঁদের লেখা কখনও পড়িনি। কোনও সাহিত্যসভাতেও দেখিনিতবু আলাপ এবং আড্ডা জমে উঠল।
হঠাৎই টুংটাং শব্দে এদিক-ওদিক তাকাতেই ছেলেটিকে দেখতে পেলাম। আটাশ-ত্রিশ বয়স। নীল জিন্সের প্যান্ট আর গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। বুকখোলা অংশের ভেতর লাল গেঞ্জিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ছেলেটি স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে গাইছে— ওগো নদী, ওগো চাঁদ, ও জ্যোৎস্নার ঢেউ / আমি কি হতে পারি তোমাদের কেউ...
ব্যতিক্রমী সুর ও গিটারের ঝংকারে গ্লাস হাতে কোমর দোলাচ্ছি সকলেই। দু’-এক ফোঁটা রঙিন জল চলকে পড়ল কোটের ওপর।

২.

আমার কাছে ওঁরা এলেন এক বসন্তের শেষ বিকেলে। তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। কোকিল ডাকছে। আমাদের ছ’বছরের মেয়ে রিচা ঝুলবারান্দায় দোল খাচ্ছে। মেঘনা তাকে বিকেলের পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। কমলা গেঞ্জির ফিতে চুষতে-চুষতে সে রাইম বলছে। আজ রবিবার। তার আন্টি পড়াতে আসবে না। আয়ারও আজ ছুটি।
আমি চেয়ারে বসে তার দোল খাওয়া দেখতে দেখতে বললাম— রিচা, অত জোরে দোল খেও না। রেলিঙে ধাক্কা লাগবে।
—না বাবা, আর স্পিড বাড়াব না। আচ্ছা বাবা, আমলকীর ইংরজি কী?
         —এমব্লিকা।                                                                                           —বাবা, সাঁওতাল কী?                                                                     
—এক ধরনের সম্প্রদায়। মাটি কাটে, চাষ করে, লেখাপড়াও শেখে।         
—বাবা, লীলা হেমব্রম আমাদের সঙ্গে পড়ে। সবাই সাঁওতাল বলে।
—ছিঃ সোনা, ওভাবে বলতে নেই।
রিচা আরও কিছু বলছিল, শোনা হল না। কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলেই দেখি ওঁরা দাঁড়িয়ে।                         কোয়েল বললেন— সেদিনই আমরা ঠিক করেছিলাম আপনার কাছে আসব। ডেট আর টাইম ঠিক হচ্ছিল না। ধ্রুবদার কাছ থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে চলে এলাম।
দিঘি রুমালটা বার কয়েক কপালে চেপে বললেন— আরও সবাই আসছেন। তারপর ওঁরাও এলেন— অভিষেক, প্রান্তিক এবং বিনয়বাবু। তাঁরা আমার থেকে ছয়-সাত বছরের বড়। এই চুয়াল্লিশ-ছেচল্লিশ। দিঘি এবং কোয়েল আমার থেকে সামান্য ছোট।
সারা সন্ধে আমরা দক্ষিণ হাওয়ার জোয়ারে ভাসলাম। অনেক গল্পই হল। নদী-পাহাড়-মরুভূমি ছাড়াও ছিল কড়াইশুঁটির কচুরি আর কষা আলুরদম। সেদিনই কি শুরু হয়েছিল ঘর ভাঙার খেলা অথবা সম্পর্ক গড়ার কাহিনি! জানি না। আমরা কেউই জানি না। রাত্রে শুয়ে মেঘনা বলল— ওঁরা খুব ভাল মানুষ।          
         —হুঁ
—ওঁরা তোমার মতো ডাম্ব-ফাউন্ডেড নয়।
—কেন, আমি কথা বলি না?
—তুমি আমার সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলো? হয় লিখছ, নয় ভাবছ।
—আর?
         —ওঁরা কত লাইফফুল! কী উচ্ছ্বাস! কী আবেগ!
ডানহাতটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে বলি– ঠিক নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো।
আমার কথার উত্তর না দিয়ে মেঘনা পাশ ফিরে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয়।

৩.

তারপর থেকে মাসে দুটি রবিবার আমার বাড়িতে আসর বসে আকাশে চাঁদ ওঠার পর। মেঘনা চোখে কাজল পরে। শ্যাম্পু করে। রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে ড্রইংরুমে। মোমো সাজিয়ে দেয় প্লেটে।
         আমাদের আড্ডার নৌকোটা ভাসতে শুরু করে। সবাই দাঁড় বায়। কেবল আমিই পারি না। মাঝেমাঝে দাঁড়ে হাত দিই বটে। বলি— পেট্রোলের দাম কমেছে।
সবাই অবাক চোখে আমাকে দেখেন। প্রান্তিক বিস্ময়টা কাটিয়ে কেশহীন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন— রাইট। এখন রোজই কমছে।
বিনায়ক সান্যাল চতুর্থ সিগারেটটি ধরিয়ে বললেন— চলুন, উইক এন্ডে আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
         অভিষেক তাঁর ট্রিম করা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করেন— কোথায় যাবেন?
—কেন, মাইথন, ম্যাসাঞ্জোর কিংবা শান্তিনিকেতন। পরের দিন রাতে ফিরে আসব।
কোয়েল বলেন— ভরা শ্রাবণের তরবারি টুকরো করবে আমাদের।
প্রান্তিক চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলেন— একটা গাড়িতে হবে না।
দিঘি যেন লাফিয়ে উঠলেন— আর-একটা গাড়ি ভাড়া করব।
         রাত্রে খাওয়ার টেবিলে মেঘনা বলল— আমাদের একটা গাড়ি কিনলে হয়। আমার হাতটা থালাতেই আটকে রইল।
—অবাক হচ্ছ? আমরা দু’জনেই চাকরি করি। ব্যাঙ্ক লোন নেব। না কেনার কী আছে! গাড়ি ভাড়া করে নিমন্ত্রণ বাড়ি যাওয়াটা ভীষণ লজ্জার।
থেমে থেমে মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করি— সন্ধ্যায় তুমি কি এক পেগ নিয়েছিলে?
মেঘনার মুখ লাল হয়ে ওঠে। কর্কশ কণ্ঠে বলে— রিচা, খাওয়া শেষ হয়েছে?
পরের দিন দুপুরে ফোন এল কোয়েলের। লাঞ্চ করছেন?
কম্পিউটার লগ অফ করতে করতে বলি— না। এবার করব। আপনি করেছেন?
—হেড অফিসে মেইলগুলো পাঠিয়ে টয়লেট এসেছি। কফি খাওয়ার পর মুখটা কেমন লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়েছি।
বললাম— রিং ছাড়তে পারেন?
—পারি।
—আমি কিন্তু আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
—কী দেখছেন?
—আপনার ক্যানভাস শ্যু-টা ইয়ালো কালারের। টিউনিকটা ভায়োলেট।
—শ্যুটা ঠিক আছে। তবে টিউনিকটা ভায়োলেট নয়। হোওয়াইট। তবে গুজরাটি কাজটা ভায়োলেট।
—ছুটির পর কী করবেন?
—দেখা করতে চান?
—ইচ্ছে হচ্ছে।
—তাই হবেবেরোনোর আধঘণ্টা আগে ফোন করব।

৪.

টিলার সামনে যখন গাড়ি থামল তখন ভোরের সূর্যের কমলা রঙে ড্যামের জল রঙিন হয়ে উঠেছে।
         বিনায়ক সিগারেট ধরিয়ে কোমরে হাত রেখে বলে উঠলেন— ক্যানভাসে আঁকা জল আর রোদ্দুরের খেলা। ওপারে পাইন বনের আড়ালে লুকিয়ে আছে আমার শৈশবের ভোর। মেঘনা, আপনি, কি আমার সঙ্গে একমত?
—না হয়ে পারি, কী করে? এই সৌন্দর্য কি আপনার একার?
—নট অফকোর্স। আপনার সঙ্গে শেয়ার করাটাও আশ্চর্য! আমার নেক্সট গল্পের টাইটেল হবে ‘মেঘনা ও ভোরের সূর্য’।
কোয়েল আমার পাশে এসে বললেন— ভাগ্যিস বিনায়কদার বউ আসেননি!
বলি— গাড়িতে পেগের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেছে।
প্রান্তিকবাবুর স্ত্রী রিনা মোটা থলথলে শরীরটা কোনওরকমে গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রায় খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এসে বললেন— ওম্মা! কী সুন্দর ড্যাম গো! বাবা, এপাশে আবার পাহাড়!
তাঁর বারো বছরের ছেলে বলল— মাম্মি ওটা পাহাড় নয়, টিলা।
—ওই হল।
অভিষেকবাবুর স্ত্রী অপর্ণা রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে ভেসে থাকা পরিত্যক্ত গাদাবোটটি দেখছেন। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জল আছড়ে পড়ছে!
বললাম— ধরুন, একটা পাথরের চাঁই ধসে গড়িয়ে এল তীব্র গতিতে আমাদের সামনে!
আঁতকে উঠে কোয়েল আমার কাঁধটা চেপে ধরলেন— উরি বাব্বা! আপনি এমন ভয় দেখান! দিঘির মেয়ে, কোয়েলের মেয়ে ড্যাম দেখছে। রিচাও রয়েছে। ওরা প্রায় সমবয়সী। ওরা ইটের টুকরো ছুঁড়ছে জলে। প্রতিযোগিতা চলছে— কারটা বেশি দূর যায়। কোয়েলের হাজব্যান্ড আসেননি।
দিঘি স্বপ্নভ্রমণ দু’ চোখ আমার মুখের সামনে তুলে বললেন— এইরকম এক দৃশ্যের কাছাকাছি আসতে আমাদের এত বছর সময় লাগল। অথচ কলকাতা থেকে সামান্যই দূরে। দিঘির চোখের ভাষা বোধহয় অন্য কথা বলছেকোয়েল রাস্তা পেরিয়ে টিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দিঘি টিলার উচ্চতা দেখতে দেখতে বললেন— যাবেন ওপারে? ওই তো কত লোক যাচ্ছে।
ওঁর স্বামী সুহাসবাবু পেছনে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন। বললেন— যান না! উঠুন যতটা পারেন।

৫.

ম্যাসাঞ্জোরের ইরিগেশন বাংলোটা ভারী সুন্দর। টিলার ওপর। চারপাশে গাছ আর গাছ। আলো আর আঁধার একসঙ্গে খেলা করে।
বিনায়ক, প্রান্তিক, মেঘনা আর দিঘি টিলার ওপাশে গেছেন। আমরা বাংলোয় চলে এসেছি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাচ্ছিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে কোয়েল বললেন— ড্যামের কাছে যাবেন? দু’জনে জলে ঝাঁপ দেব!
—সাঁতার জানেন?
—আপনাকে ধরে রাখব।
—আপনার ঠোঁটে একটু ঠোঁট ছোঁয়াব?
—আপনার লেখায় যত জোর, মনে তত নেই। চুল জড়াতে-জড়াতে কোয়েল বললেন। সুহাসবাবু কখন উঠে এসেছেন বুঝতে পারিনি। সিগারেট ধরিয়ে বলেন– কেয়ারটেকারকে টিফিনের ব্যবস্থা করতে বলি?
—এখনই? সবে তো সাড়ে ছটা?
—ঠিক আছে। তবে এখন একটু কফি দিতে বলি?
—তাই বলুন।
কোয়েল টয়লেটে গেলেন। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাই। পাশের রুম থেকে অভিষেকবাবুর গলা ভেসে এল— জীবনটা কি মনে হয় না ভীষণ একঘেয়ে? অপর্ণা বললেন— একটু অন্য খেলা দরকার। খেলবেন?
অভিষেক বললেন— তবে চলুন, আমরাও হারিয়ে যাই।

৬.

খেলাটা বেশ জমে উঠেছে।
কে যে কোথায় হারিয়ে গেল জানি না। বাচ্ছাগুলো বাংলোয় ব্যাডমিন্টন খেলছে। আমার বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে কোয়েল বললেন— আমাকে কোনওদিন মন থেকে মুছে ফেলবেন না তো? ওঁর শরীরে মৃদু কম্পন।
ওঁর ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে বলি— আপনিও প্রমিস করুন!
হুহু হাওয়ায় উড়ছে পর্দা।
বুড়ো লোকটি কফির ট্রে-টা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখল।
মেঘনা এল। চোখের কাজল ধেবড়ে গেছে। ঠোঁটে আবছা লিপস্টিক।
দিঘির মুখটা থমথমে। টয়লেটে ঢুকে পড়লেন।
রিনা ম্যাডাম কফি হাতে পাশের রুম থেকে এসে চেয়ারে ধপ করে বসে বললেন— সবাই গেল কোথায়? চেয়ারটা দুলে উঠল।
—হারিয়ে গেছেন।
—ওম্মা! সে কী কথা? একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিছুই বুঝতে পারিনি।
—একটু অপেক্ষা করুন, সবাই ফিরে আসবেন। প্রকৃতির মাঝে খেলাটা হয় অন্যরকম।

৭.

আড্ডা বসতে-বসতে বেলা অনেকটা দীর্ঘ হল। ব্যালকনির সব চেয়ারই ভরে উঠেছে। একটু আগে পাশের রুমে প্রান্তিকবাবুর সঙ্গে রিনা ম্যাডামের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। রিনা ম্যাডাম আড্ডায় আসেননি।
শূন্য দৃষ্টি মেলে অপর্ণা নিশ্চুপ বসে রয়েছেন। অভিষেক কথা বলছেন। কথাগুলি যেন টিলার ওপাশে রেখে এসেছেন। আড্ডার পরিবেশটা একেবারেই তৈরি হচ্ছে না।
সুহাসবাবু বললেন— নাভির ওপর ব্যথাটা কি আমাশার?
বিনায়ক সিগারেটের প্যাকেট খুঁজতে খুঁজতে বললেন— ওটা গ্যাসের ব্যথা। আপনার হচ্ছে?
—সামান্য।
প্রান্তিক হঠাৎই বলে উঠলেন— কাদম্বরী দেবী কেন স্যুইসাইড করেছিলেন জানেন?
সে কথার উত্তর না দিয়ে বিনায়ক বললেন— মা সারদা একজন সাধারণ গ্রাম্যবধূ। কিন্তু তাঁর মনন-বোধ-অনুভব...
মেঘনা একটু জোরেই বলে ওঠে— আজকের আড্ডার বিষয় কি এইসব?
দিঘির জড়তা কেটে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিঙে ঝুঁকে বললেন— কী কাব্যময় দিন একটা!
—আপনি কি কবিতা লেখার কথা ভাবছেন?
—দু’-একটা কবিতা বেরিয়ে এলে ক্ষতি কী?
বাংলোর সামনে থেকে শিশুদের চিৎকার ভেসে আসছে।
জিজ্ঞেস করি, লাঞ্চ ক’টায়?
বেরিয়ে যেতে যেতে সুহাসবাবু বললেন— একটায়।
—আমরা বেরোব ক’টায়?
—এই তিনটে সাড়ে তিনটে।
কিছুক্ষণ পর আমিও বেরিয়ে পড়লাম। র‍্যাকেট ফেলে রিচা বলল— তোমার সঙ্গে যাব।
—চলো।
হাঁটতে-হাঁটতে রিচা জিজ্ঞেস করল— বাবা ঘরভাঙা কী?
—কেন?
—মা কোয়েল আন্টিকে বলছিল, তুমি আমার ঘর ভাঙছ। কেন? কেন?
আমার শিরাগুলি যেন শিউরে ওঠে
—অন্য কোনো কারণে বোধহয় বলেছে। একথা কাউকে বোলো না।
—তুমি যখন টয়লেটে ছিলে মা কাঁদছিল। প্রান্তিক আঙ্কেল মায়ের চোখ মুছে দিচ্ছিল রুমালে।
সত্যিই খেলাটা জমে উঠেছে। এটাই কি মুক্তির খেলা! ভাঙন অথবা সৃষ্টির খেলা!
—বাবা, আমার র‍্যাকেটের নেটটা ছিঁড়ে গেছে। একটা কিনে দেবে?
—দেব।
হাঁটতে-হাঁটতে আমরা ড্যামের ওপর চলে এলাম। লকগেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুহাসবাবু সিগারেট টানছেন। আমাদের দেখে টুপিটা একটু নাড়িয়ে বললেন— কেমন লাগছে?
—ভাল
দুটো গেট খোলা। তুমুল গতিতে জল বেরোচ্ছে। ছিটকে ওঠা জলের কণায় ধোঁয়াটে ভাব তৈরি হয়েছে। রিচা অবাক চোখে দেখছে। জলের কণা গায়ে এসে লাগছে। কী ঠান্ডা জল।
সিগারেটের প্যাকেটটা আমার সামনে এগিয়ে ধরে বললেন— আপনাদের লেখার অজস্র বিষয় মশাই চারপাশে ছড়িয়ে। শুধু প্রকৃতি নয়, মনের ভিতর-বাহিরও মিশে আছে এই তমালবনে-পাইনবনে।
কথার অর্থ বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। সুহাসবাবুর ফোনটা বেজে উঠতেই অন করে বললেন— বলো!
জলের শব্দের মধ্যেও শুনতে পাচ্ছি ও প্রান্তের মেয়েলি কণ্ঠস্বর।
সুহাসবাবু বললেন— ফাইন। ভেরি ফাইন। অনেক কিছুই আবিষ্কার করছি। পাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া।
...
         —ফোনে ঠিক কথা বলা যাবে না, গিয়ে বলব।
ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গিটাই অন্যরকম।
...
         —একবার সার্জেনকে দেখিয়ে নাও
...
—সম্পর্কহীনতার মধ্যেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। ঠিক আছে, রাখছি
ফিরে আসার জন্য রিচাকে ডাকলাম।
সুহাসবাবু ফোনটা বুকপকেটে রেখে বললেন— বুঝলেন লেখক!
বলুন—
আপনার এবারের উপন্যাসটার সাবজেক্ট করুন সম্পর্কহীন সম্পর্ক। পাঠক খাবে। মার্কেটে চলবে দারুণ
সরু চোখে মানুষটাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে-করতে মনে হল খেলাটা আরও জমে উঠল।

1 comment: