জ্বরজসম্ভব
দলছুট এক অনাথকে ছিমছাম একটা ক্যাফে থেকে বার্গার আর সফটি খাওয়ানোর পর এক সংবেদনশীল মহিলা জিজ্ঞেস করল— কাকে খুঁজতে এদিকে এসেছিলে?
—সেই লোকটা...
—কোন লোকটা?
—যে আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলত।
—কোথায়?
—যেখানে থাকি... তার সামনে।
—কোথায় থাকো?
—হোম
—অনাথাশ্রম?
—
—মাকে দেখতে ইচ্ছে করে?
—বড় হলে যখন নিজের গাড়ি হবে... সেই গাড়ি করে
মাকে খুঁজতে বেরব।
—দেখলে চিনতে পারবে?
—
—দেখেছো কখনও আগে?
—না।
—তাহলে?
—
—তোমার মা হয়ত তোমাকে দেখে
চিনলেও চিনতে পারে... যদি...
—যদি?
—যদি চিনতে চায়।
—মানে?
—এসো... হাঁটতে
হাঁটতে বলছি।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা চলে গেল
সেই সংবেদনশীল মহিলার সঙ্গে। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে। তার পরিচিত হোম থেকে দূরে... শহরের অন্য
প্রান্তের দিকে।
—মাকে খুঁজে পেলে কী করবে?
—মায়ের সঙ্গে থাকব... মাকে নিয়ে
ঘুরব, আনন্দ করব।
—আর যদি মা থাকতে না চায়?
—মানে?
—তুমি ছোট। কিন্ত জানার অধিকার
সবার আছে... তোমারও...
—কী জানব?
—সত্যি।
—কোন সত্যি?
—তোমার মা তোমাকে চায়নি। কেউ
চায়নি তুমি আসো। কেউ চায় না তোমাকে, কেউ চায়না তোমাদের।
—না!
—হ্যাঁ... কেউ চায়না
বলেই কেউ খোঁজ করে না তোমাদের। তোমরা হোমে পড়ে আছ। কেউ এসে নিয়ে যায় না। তোমরা
কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ নও। নিজেরা নিজেদের বয়ে বেড়াবে... বয়ে বেড়াতেই
শিখবে যত বড় হবে। বয়ে বেড়ানো অভ্যেস করবে।
—
—জানি, এগুলোর মানে
কিছুই বুঝবে না। শুধু জেনে রাখো... যাদের কেউ চায় না, জগতে তাদের
কোনও দরকার নেই। আর যাদের কোনও দরকার নেই, তাদের থাকা
না থাকা সমান।
—
—কী হল?
—কেউ চায় না আমাকে? মাও না?
—মাকে দেখবে?
—তুমি জানো মা কোথায়? চেনো মাকে?
—উঁহু, তবে কোথায়
পেতে পারো... হয়তো জানি।
—কোথায়?
—এসো আমার সঙ্গে...
ওরা হাঁটতে হাঁটতে শহরের সেই প্রান্তে চলে গেল, যেখানে
রাস্তায় লোকজন নেই... বাড়িঘর নেই। নগরায়নের চিহ্ন সেখানে সীমিত। শহর ছাড়িয়ে সেখান
থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে অন্য দিকে... অন্য এক শহরতলি। সেই অনাথ
ছেলেটির কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জগৎ।
—এই রাস্তা ধরে চলে যাও হাঁটতে
হাঁটতে। যেখানে এই পথ শেষ হয়েছে, সেখানেই তোমার মাকে পাবে।
—চিনতে পারব কী করে?
—জানি না...
—তাহলে?
—হয়তো তোমার মা তোমাকে চিনতে
পারবেন।
—মা চিনতে পারলে, কাছে ডেকে
নেবে!
—আর যদি না ডাকে?
—?
— তাহলে নিশ্চয় তুমি বিশ্বাস
করবে আমার কথা... তোমার মাও
তোমাকে চায় না। তোমাদের থাকা না থাকার কোনও মানে নেই। এটাই সত্যি... আর সেই
সত্যির মুখোমুখি তোমাকে হতে হবে তখন।
—
—যাও, মাকে খোঁজো... সত্যির
মুখোমুখি হও। আমি এই রাস্তাতেই তোমার ফেরার অপেক্ষা করব।
ছেলেটা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল অন্য শহরতলির দিকে। তার
ছোট্ট ছায়াটা মাথা নিচু করে চলে গেল তার সঙ্গে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা ছায়াটা
আরও লম্বা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ফিরে গেল শহরের দিকে। কারও জন্য অপেক্ষা করার দায়
তার নেই। যদি, মানুষের
সংবেদনশীলতার আয়ুষ্কাল চোখের আড়াল হওয়া অবধি... তবে, সেই
নারীকণ্ঠের সংবেদনশীলতায় কোনও ত্রুটি ছিল না।
পরিচিত হোম, হোমের সামনে এক চিলতে সবুজ মাঠ, এসব থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া সেই রাস্তাটা একটা লম্বা সেতুর মত। তার ওপারে সূর্য ঢলে রাত নেমে আসে। লাইটপোস্টের আলোয় ফরফর করে রাতপোকারা। এদিকে ওদিকে দেখা যায় গোলাপি, লাল, হলুদ কিংবা নীল আলোয় লেখা শব্দ। পড়তে গেলে মাথা ঘোরে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখানে ওখানে নানারকম গান আর সুর... বেজে চলে একটানা। রঙিন ফ্লুরোসেন্ট আলোয়ে মায়াবী হয়ে ওঠে নারী-শরীরের উদ্ভাসিত ত্বক আর জ্যামিতি। কমনীয়, মায়াবী, আচ্ছন্নতার গন্ধ মাখা আপাত সব কিছু। রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেই শহরতলি অঞ্চল এক অন্য জগত। শহর থেকে দূরে গড়ে ওঠা এক বেশ্যানগরী। যদিও, অনাথ ছেলেটির বয়স সবে এগারো... এসব তার কাছে ভিনগ্রহের মতো। সে উদ্বিগ্ন হচ্ছিল, তার মাকে কী করে চিনতে পারবে এই কথা ভেবে... অথবা, তার মা তাকে কী করে চিনবে, সেই কথা ভেবে।
একটা দালাল হতভম্ব কচি ছেলে
দেখে জিজ্ঞেস করল— কীরে ছোঁড়া, কাকে খুঁজছিস?
—মাকে।
—মাকে? মাকে খুঁজছিস?
—হুম।
—আমিও।
—তুমিও তোমার মাকে খুঁজছ?
—না-না... তোর মাকে
খুঁজছি!
—তুমি মাকে চেনো? মাকে দেখেছ?
—হ্যাঁ... এখানেই তো
আছে! খুঁজলেই পাবি!
—কোথায়?
—এই তো... গোটা পঞ্চাশ
এখানেই ঘুরঘুর করছে। যাকে চাস তার কাছে চলে যা। ডাক দে... যে সাড়া দেবে
সে-ই তোর! হা-হা-হা-হা-হা...
লোকটা হাসির দাপটে কাসতে শুরু
করল। কাসতে কাসতে বসলে পড়ল মাটিতে। হাত থেকে পড়ে গেল সিগারেটটা। তখনও হেসে যাচ্ছে।
হাসি আর কাসি, মিশে গেছে।
থামছে না কোনওটাই। ছেলেটা ভয়ে পালিয়ে গেল। হাজার হাজার মা আর 'হা-হা'দের থেকে
দূরে।
চারজন বেশ্যা দাঁড়িয়েছিল একটা রংচঙে বিজ্ঞাপনের
বোর্ডের সামনে। সেই বিজ্ঞাপনে এক অভিনেত্রীর আহ্বান চোখ মারছে বোকা গ্রাহকদের।
মেয়েগুলোর মধ্যে দু'জন পরে আছে মিনি স্কার্ট, একজন পরে আছে
স্লিভ্লেস ডীপ নেক চুড়িদার। আর একজন পরে আছে স্বচ্ছ নীল শাড়ি।
ছেলেটার দিক্ভ্রান্ত চোখ দেখে
তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, কী রে কাকে খুঁজছিস? ছেলেটা মুখ
ফসকে শুধু বলল ‘মা। সঙ্গে
সঙ্গে একজন ছুটে এসে তাকে জাপটে ধরে বলল ‘সোনা আমার! এতদিন কোথায়
ছিলি তুই মানিক? আমি ঠিক
চিনতে পেরেছি তোকে!’ সেই মেয়েটি ছুটে এল, যে চুড়িদার
পরেছিল।
জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিল
ছেলেটার মুখ। ছেলেটা এক অব্যক্ত সুখে বিহ্বল হয়ে গেল। ‘মা চিনতে
পেরেছে! তাহলে আমাকেও
কেউ চায় এই পৃথিবীতে। আমি একা নই!’
হঠাৎ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা
বেশ্যাদের একজন বলে উঠল— তুই এমন ধেড়ে বাচ্চা পাড়লি কবে?
আর-একজন বলে উঠল— না-না... অন্য কেস... কচি শশা খেতে
ভাল লাগে মলির!
তৃতীয় কণ্ঠস্বর বলল— দেখ কোথায়
বেলুন ফেটে গেছিল... সেখান থেকে এসেছে।
ছেলেটিকে যে এতক্ষণ জড়িয়ে চুমু
খাচ্ছিল, সেই মেয়েটি
এবারে থামল। এক ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে দূরে সরিয়ে বলল— তোর মত গান্ডু নই... শুয়োরের
ফ্যাদা নিয়ে বাচ্চা পাড়তে বয়ে গেছে আমার!
ছেলেটা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে
রয়েছে তখনও তার দিকে। ধাক্কা সামলাতে সামলাতে মনে হচ্ছে পায়ের তলায় মাটি নেই।
সেখান থেকে ছুটে পালাতে পালাতে শুনতে পেল পেছনে তখন ধস্তাধস্তি চলছে। একজন আর-একজনকে
বলছে চুলের সেটিং নষ্ট না করতে।
ছেলেটা গলির এক কোণে একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এতক্ষণে তার মনে হল— সে হারিয়ে গেছে। তার আর যাওয়ার কোনও
জায়গা নেই। যে পথে এসেছে সেই পথটাও কোনদিকে বুঝতে পারছিল না। খিদে পাচ্ছিল, তেষ্টা
পাচ্ছিল... সব থেকে বেশি ‘মা পাচ্ছিল’, যে তাকে
এখনও চিনতে পারছে না।
—না-না... এখানে না! প্লিজ! ওই বাচ্চাটা
এখানে আছে... দেখবে আমাদের!
চমকে উঠে ছেলেটা দেখল কাছেই
একটা উলটনো জলের ড্রামের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একটা মেয়ে। সে-ই বারণ করছে
এই ভাবে। বারণ করছে সেই লোকটাকে যে মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে। ‘দেখলে দেখুক... এখানেই... এই ছেলে, দেখ ভালো
করে।’ বলতে বলতে
লোকটা নিজের প্যান্টের হুক আলগা করে জিপ খুলে ফেলল। জাঙিয়াটা নামিয়ে নিল সুবিধে মতো।
এইসব কিছুই করল একহাতে, অন্য হাতে মেয়েটাকে ধরে রইল সেই
জলের ড্রামের সঙ্গে। এসব করতে করতেই বলল— আমি একটা কলেজে পড়াই... সেখানে সবাই
আমাকে সম্মান করে। তোরাও করবি... বুঝেছিস? সব কিছুর
একটা দাম আছে! অ্যাই বাচ্চা... দেখ। দেখে
শেখ!
ছেলেটার বুকের ভেতর হাতুড়ি পড়তে
লাগল। সেই তালে তালে মেয়েটার স্কার্ট তুলে লোকটা একটানা ধাক্কা দিয়ে গেল পেছন
থেকে। মেয়েটা চিৎকার করলেও পালাচ্ছে না, লোকটার চিৎকার অনেকটা শুয়োরের ডাকের
মত। আসলে দু'জনের চিৎকারই
শুয়োরের মত। শুয়োর মারা হলে মেয়েটার মতো চিৎকার করে, আর শুয়োর
মারপিট করলে লোকটার মতো।
লোকটা একসময় থামল। মেয়েটার পিঠে
নিজের কপালের ঘাম মুছল। তারপর একটা পাঁচশো টাকার নোট মেয়েটার টি-শার্টের ভেতর
গুঁজে দিলো। আর একটা একশো টাকার নোট রেখে দিল ছেলেটার দুটো হাঁটুর ফাঁকে। ‘দাম দিতে হয়
সবকিছুর!’ বলে চলে গেল
লোকটা। মেয়েটাও কেমন ছিঁচকে চোরের মতো টাকাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সন্তর্পণে গা ঢাকা
দিল গলির তলপেটে।
ছেলেটার হাঁটু দুটো তখনও
কাঁপছে। বুকের ভেতর হাতুড়ির আওয়াজটা এক দমক বমি হয়ে এসে পড়ল সামনের রাস্তায়।
—তুমি এভাবে বসে আছো?
—খারাপ... খুউউউব শরীর
খারাপ!
—আমারও
হালকা বাদামি চাদর জড়িয়ে কুঁকড়ে
বসে থাকা মহিলা এবার মাথাটা তুলে তাকাল। সে চাদর পুরনো হয়ে গেছে, হাত বদলও
হয়েছে অনেকবার। প্রৌঢ়া না হলেও, বিগতযৌবনা। দুর্বল... চোখের তলায়
কালি, গাল তুবড়নো।
হাতের কবজির কাছে ছোট ছোট পোড়া দাগের মতো। ঘাড়ের কাছে একটা চাকার মতো ঘা। ছেলেটা
এতক্ষণ যতরকম মেয়ে দেখেছে, এ তাদের মতো না। এই গলিতে আর
কাউকে দেখা যায় না। মশা উড়ছে চারিদিকে। কানের কাছে ঘুরছে পোঁ-পোঁ শব্দ করে।
চারিদিক থেকে ভেসে আসছে দেওয়াল ভিজনো পেচ্ছাপের গন্ধ। ছেলেটাও একটু আগে এক কোণে
গিয়ে করে এসেছে। জামাটা সামান্য ভিজে। বমি করার পর এক জায়গায় রাস্তার কলের জল
খেয়েছিল, তখন বুকের
কাছটা ভিজে গেছে। মুখে-মাথায় জল দিয়েছিল। তাই মাথার
চুল এখনও ভিজে। শীত করছে। তার চেহারাও এখন অদ্ভুত ভাবেই
বদলে গেছে এক সন্ধের মধ্যেই। নিজেই নিজের মুখ দেখলে চমকে উঠত। মাথার মধ্যে কেউ
নামতা পড়ার মতো বলছে ‘কেউ চায় না... কেউ নেই’
চাদর ঢাকা মহিলা হঠাৎ খেঁকিয়ে
উঠল— এখানে কী চাই?
—কিছু না।
—?
—শরীর খারাপ... তাই একা
এভাবে বসে আছো?
—আমার কাছে কেউ আসতে চায় না। ক’দিন
পরেই মরে যাব।
—মরে যাবে!
—হ্যাঁ... মরে যাব। ওরা মরে
যাওয়ার ভয়ে আসে না!
—
—খুব খুব খারাপ লাগছে... মরার মতো।
চাদরের ভেতর থেকে শিরা বেরিয়ে
আসা রোগা হাতটা বার করে মহিলা বলল— ক'টা টাকা হবে?
ছেলেটার জামার বুক পকেটে তখনও
সেই একশো টাকার নোট ভাঁজ করে রাখা। সামান্য ভিজে গেছে ছিটকে আসা জলে। পকেটে হাত
দিয়ে সেটা বার করল। সঙ্গে সঙ্গে ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নিল সেই মহিলা। বাদামি
চাদরটা ফেলে দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে। টাকাটা কেড়ে নেওয়ার সময়ে ছেলেটাকে ধাক্কা
দিয়েছিল, বলেছিল ‘মর শালা’। ছেলেটা
স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে ওই পালিয়ে যাওয়া দেখল। পেচ্ছাপের
গন্ধটা তখন নিজের শরীর থেকেও পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ ওকে তুলে
নিয়ে একটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই হয়। মনে হচ্ছিল— একদিন কেউ এখানেই কোনও ডাস্টবিনে
ওকে ফেলে দিয়েছিল।
‘ঠিকই বলেছিল সে... কেউ চায় না।
আসলে কেউই কখনও চায়নি আমাকে। এই পৃথিবীতে আমাদের কেউ চায় না।’
পায়ের ওপর বসা ঝাঁকে ঝাঁকে
মশাগুলোকে তাড়াতেও ইচ্ছে করছে না আর।
এই জায়গা থেকে জলপ্রপাতের শব্দ ভেসে আসে। শহরতলিতে
জলপ্রপাত নেই, তার শব্দ
আছে। একটা বিশেষ জায়গায় গেলে তার ডাক শুনতে পাওয়া যায়। ছেলেটি সেদিকেই হাঁটতে
হাঁটতে চলে এসেছে। ফিরে যাওয়ার সেই সেতুটা খুঁজতে ইচ্ছে করছে না। খুব অপ্রয়োজনীয়
মনে হচ্ছে সেই সেতুটা। অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে হোমের সেই জীবন, যেখানে থাকা
না-থাকার মধ্যে
কোনও তফাত নেই। অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে... নিজের মত। ‘কেউ চায় না।’ কথাটা আবার
একবার অস্ফুটে বলে এগিয়ে গেল রেলিং-এর দিকে। শহরের অনেকগুলো হাই-ড্রেনের জল
মিশে আছড়ে পড়ছে চল্লিশ ফুট নীচে আর একটা খালের জলে। রাতের আকাশের মত কালো সেই জল।
রাত ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলপ্রপাতের শব্দ করে। গুঁড়ো জল বাতাসে উড়ছে, বাতাসে ভাসছে
নর্দমার গন্ধ। ছেলেটা তখনও নিজের গা থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ পাচ্ছিলো। নর্দমার গন্ধটা
বেশ মানিয়ে যাচ্ছিল তার সঙ্গে মিশে। রেলিং-এর ধারে এসে
মাঝে মাঝে কেউ ওপর থেকে আবর্জনার প্যাকেট ফেলে দিচ্ছিল সেই খালে। স্রোতে ভেসে
যাচ্ছে ফেলে দেওয়া প্যাকেটগুলো। আরও অনেক কিছু, ছেলেটা
অন্ধকারে ভাল বুঝতে পারছিল না। সব কিছু চেনেও না। চেনার কথা না।
রেলিংটা টপকালে একফুট চওড়া
দাঁড়ানোর জায়গা... আর এক পা
বাড়ালেই...
রেলিংটা টপকানো খুব সহজ। এখন আর
কোনও পিছুটানও নেই। ‘মা চিনতে পারেনি... চিনেও ডাকেনি... মা কোনওদিনই
চায়নি আমাকে। ফেলে দিয়েছিল।’
রেলিংটা শক্ত করে ধরে নিচের
দিকে ঝুঁকে তাকাল একবার। প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে খালের জল। ঝাঁপিয়ে পড়ছে
অন্ধকার রাত। পাক খেয়ে উঠছে নর্দমার গন্ধ। শুধু রেলিং পার হয়ে দু'পা এগোতে
হবে। এবারে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, সে সত্যির মুখোমুখি হওয়া বলতে
ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিল। এই যে সত্যি ভেসে যাচ্ছে চল্লিশ ফুট নীচে। নর্দমার গন্ধ... না সত্যির
গন্ধ পাক খাচ্ছে চারিদিকে।
রেলিং-এর ধাপে পা
দিয়ে ছেলেটা একটা জোনাকি দেখতে পেল। অন্য সময় জোনাকি ধরতে ইচ্ছে করে, প্রজাপতি
ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তখন ইচ্ছে করছিল প্রজাপতি আর মথদের পায়ের তলায় পিষে দিতে।
ইচ্ছে করছিল কুকুরের বাচ্চাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে খালের জলে। একা জোনাকিটাকেও মনে
হচ্ছিল অনাথ। কেউ নেই... কেউ চায় না ওকে। সেও ঝাঁপ দিতে এসেছে এই রাতের গভীরে।
রেলিংটা আরও শক্ত করে ধরে রেলিং-এর ধাপে পা রাখতে বুঝতে পারল আর
পা কাঁপছে না আগের মত। মনে কোনও দ্বিধা নেই। দ্বিতীয় পা-টাও রাখলো
সেই ধাপে, এবারে শুধু
ওপারে যাওয়া। ঠিক তখনই আরও একটা জোনাকি দেখা গেল... তারপর আরও
একটা। সেই খালের গভীর থেকেই যেন এক একটা জোনাকি উঠে আসছে। আকাশে তারা ফোটার মত সেই
বয়ে চলা অন্ধকার স্রোতে একটা একটা করে জোনাকি ফুটে উঠল... যত দূর দেখা
যায়।
জোনাকিরা কেউ মা নয়... তাদের চেনা, বা তাদের ডাক... কী আসে যায়
তাতে?
ছেলেটার হাতের তলা ঘামছিল, ঘামে পিছলে
যাচ্ছিল পায়ের তলাও। একটা ভিজে হাওয়া বইতে শুরু করল হঠাৎ... ঠিক যেমন
বৃষ্টির আগে বইতে শুরু করে। সোঁদা গন্ধের সঙ্গে নর্দমার গন্ধ পাক খেয়ে উঠল। ঠিক
যেমন দশ থেকে এক গোনার মাঝে একটা সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়ে যায়... সেভাবেই আবার
রেলিং থেকে নেমে এসে পিছিয়ে গেল পা দুটো।
এখন রথের গৃহাভিমুখে যাত্রার কথা, তাই না?
ওই খালের পাশের রাস্তাতেই
কয়েকটা অটো দাঁড়িয়ে থাকে। অটোওয়ালা শহরে ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য কাস্টমার পায়।
বাড়তি টিপ্স বা অন্য কিছুও পেয়ে যায় কোনও কোনও দিন। এক মুঠো জোনাকির আলোর বিনিময়
যদি কেউ শহরের দিকে নিয়ে যায়! এমনিতেই রাতে একা ফেরার জন্য
হোমে দু-ঘা খেতে হবে... খাওয়ারই কথা।
বেশি দেরি হ'লে রাতের
খাওয়াটাও যাবে। অবশ্য মাসি দুটো রুটি আর তরকারি ঠিক রেখে দেবে। এখন খিদেটা ফিরে
এসেছে বলে এত কিছু মনে হচ্ছে... একটু আগেও মনে হচ্ছিল না।
বৃষ্টিটা শুরু হয়ে গেল ঝিরঝির
করে। মাসি জিজ্ঞেস করবে ‘কোথায় ছিলি?’ পল্টনদা
জিজ্ঞেস করবে ‘কোথায় ছিলি?’ রতনকাকা
জিজ্ঞেস করবে ‘কোথায় ছিলি?’ হোমের যারা
কেউই সন্ধের পর বাইরে থাকে না, তারাও জিজ্ঞেস করবে। আজ ফিরে
যাওয়ারই কথা। কয়েক বছর পর, হঠাৎ একদিন রাতে... যখন সবাই ঘুমোচ্ছে, কাউকে না
জাগিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। চুপচাপ... একা। এদিকে
নয়... অন্য
কোনওদিকে গিয়ে দেখতে হবে
কেউ চিনতে পেরে ডাকে কিনা! মা? মা... অথবা কোনও
কেউ!
ছেলেটা ভিজতে ভিজতে একটা অটোর
ভেতর বসল। অটোওয়ালাকে দেখেই চিনতে পারল -- সেই লোকটা, যে মাঝে মাঝে
মাঠে ফুটবল খেলতে আসে। হ্যাঁ... সেই তো! আয়নায়
ছেলেটার প্রতিবিম্ব দেখে হাসল একবার।
সম্মোহিতের মতো অনাথ ছেলেটি
তাকে বলে উঠল— প্রাসাদে ফিরে চলো সারথি, আমার জ্বর আসছে!
ভালো লাগলো
ReplyDelete- অলোকপর্ণা