একজন বিবাগী
মাঘে বাঘের হাড় কাঁপানো শীত আর নেই এখন।
গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের গালগল্পের মতোই এখন অদেখা এই শীত। খালি চোখে
আকাশবাতির দিকে তাকালে তাকে একটা ঘোলা সোডিয়াম লাইটের মতোই লাগে। চোখ পিটপিট করে
তাকায় একবার জরুল। সাদা-কালো হয়ে যাওয়া শক্ত দাড়িতে হাত বুলায় আর একটু করে চুলকিয়ে
নেয়। সে ভাবতে থাকে, এই একই সূর্য কিছুদিন বাদেই কী ভয়ঙ্কর রূপ ধরবে। তাকাতে গেলেই
ভ্রূ কুঁচকে যাওয়া চোখের আলো কালো হয়ে আসা তেজে ফিরবে সূর্য।
জরুল এক জায়গায় থেমে
যায়। জায়গাটা পাহাড়ের একটা চূড়া। সে ভাবে তাহলে শীতের সূর্য তার তেজ হারায়, নাকি খোয়া
(কুয়াশা) তার আবরণে ঢেকে দেয় এই তেজি জিনিসটাকে? এত বছরের রোদে পোড়া শরীর, আর খেটে
খাওয়া জীবনের মারপ্যাঁচে সে ঠিকই বুঝতে পারে আসল গোমর। মেঘ যেমন চাঁদের আলো ঢাকতে
পারে না, কেবলই আমাদের চোখ ঢেকে দিয়ে যায়। তেমনি সূর্য তার কাজ ঠিকঠাক করেই যায়।
ঋতুর আসা-যাওয়া ভালোবাসার মতোই। মনের উপরে-নীচে সে অনেক খেলা খেলে যায়। কিন্তু সেই
মন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নানান রং পাল্টায়।
জরুল অনেকটা পথ হাঁটার
কারণে এখন বসে আছে গ্যালেঙ্গা রাস্তার মাথায়। সামনে অদূরে সাত কিলো দূরে নীলগিরী।
তাকে এখন যে রাস্তাটা পার হতে হবে সেটাও প্রায় পাঁচ কিলো নীচে পাহাড়ের কোলে। ধীরে ধীরে এই রাস্তা নেমে গেছে গ্যালেঙ্গা। এটি একটি পাহাড়ি
জনপদ। চিম্বুক পাহাড় ফেলে প্রায় বিশ-বাইশ কিলো হেঁটে এইটা একমাত্র জিরিয়ে নেওয়া
জরুলের। জোয়ান বয়সে সে প্রায় এক হাঁটাতেই চিম্বুক থেকে গ্যালেঙ্গা পৌঁছে যেত। সেসবও
এখন গোয়াল ভরা গরুর মতোই গালগপ্প। সব আসলে বয়সের খেল। জোয়ান বয়সের তেজ আর এই শেষ
বয়সের জীবনের গতি সব ওলোট-পালোট লাগে জরুলের নিজের কাছেই।
তবুও পাহাড়ের আলাদা
গন্ধের টানে এই পথটা সে পায়ে হেঁটেই যায়। কিসের যেন একটা মাদকতা আছে এই গন্ধে।
জরুলের ভালো লাগে। এই পড়ন্ত বয়সেও সে ফিরে যাচ্ছে তার অতীতের কাছে। নাকি পাহাড় তার
নিজের আবেদনে জরুলকে টেনে নিয়ে আসে? এইসব কথা জরুল অনেক ভেবেছে। যতবারই পাহাড়ের
কোলে সে ফিরে আসে, তার মনে এইরকম অনেক ভাবের উদয় হয়। জরুল জানে পাহাড় জীবন্ত। সে
সবাইকে নেয় না তার বুকে। জরুলকে অবশ্য নিয়েছে। সেই সাতাশ বছর আগে টগবগে তরুণ
রক্তের জরুল প্রথম পাহাড়ের কোলে আসে। ঠিক সেইদিনের কথা এখনও তার মনে তরতাজা। এমন
ভাবে মনে জাগে যেন ভোররাতের স্বপ্ন। একটু চেষ্টা করলেই পুরোটা মনে পড়ে।
মিনিট দশেক জিরিয়ে নেয়
জরুল। এর মাঝেই সে সঙ্গে থাকা ব্যাগের ভেতর থেকে দুটো কলা বের করে খায়। তারপর
বুকপকেট থেকে সস্তা সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজিয়ে দিয়ে দাঁত
দিয়ে কামড়ে ধরে। লুঙ্গির কোঁচা থেকে ম্যাচ বাক্স
বের করে কাঠিটা জ্বালাবার ঠিক আগ মুহূর্তেই আবার আকাশের দিকে তাকায়। বেলা কত হল
মেপে নেয় মনে মনে। খুব বেশি বেলা বাকি নেই। দিনের আলো বড়জোর আর ঘণ্টাখানেকের চেয়ে
একটু বেশি থাকবে। কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নেয় সে। ম্যাচের ধোঁয়া নাকি
সিগারেটের ধোঁয়া কে জানে, তার চোখে লাগে। চোখ-মুখ কুঁচকে সে বিরক্তি আড়াল করার
জন্য আরাম করে ধোঁয়া ছাড়ে। এর মধ্যেই সস্তা দামের মোবাইল ফোনে কল আসে।
তাকে ফোন দিয়েছে উচমং
দাদা। আহা! বড় ভালো মানুষ! জাতে পাহাড়ি, মারমা জাতের মানুষ। নিজের ভাইয়ের মতো করে
তাকে সমাদর করে। ফোন কানের কাছে তুলেই ব্যাগ টেনে নেয় কাঁধে। সেই সঙ্গে সিগারেটে
একটা বড় টান দিয়ে হাঁটতে শুরু করে, জরুল বলে উঠে, ‘নমস্কার দাদা! এই গ্যানেঙ্গা
রাস্তার মাথায় দাদা। হাঁটি আসতে যতক্ষণ
লাগে...’
এই পথটুকু শুধুমাত্র
নামা পথ। ক্রমাগত নীচের দিকে নামতে নামতে ঠিক সাঙ্গু নদীর কুলের কাছেই পাহাড়ের
পাদদেশে তার গন্তব্য। এই বিকেলের পাহাড় নতুন বধূর মতোই সুন্দর, মায়াবী। জরুল না
চাইলেও হাঁটার গতি বেড়ে যায়। পৃথিবী কোনও কিছুতেই তার নিয়ম ভাঙে না। জরুলের পড়ে
যাওয়া বয়সের কাছে এই নেমে যাওয়া রাস্তায় এইভাবে নেমে যাওয়াটা শরীর মানবে না।
কিছুদূর যাবার পরেই তার পায়ের পেশি ধরে যায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, এই আর ক্ষণিক
বাদেই এই ব্যথা শরীর সয়ে নেবে। সে যেমন সয়ে গেছে তার বিগত জীবনের অনেক ব্যথা। সেসব
অবশ্য মনের ব্যথা।
মুরং পাড়ার মুখে এসেই
তার তেষ্টা পায়। কিন্তু পানি খেতে হলে তাকে ঢাল ধরে হাতের ডানে আরও কিছুদূর নেমে
যেতে হবে। নিজের মনে সায় পায় না। এই জায়গাটা পাহাড়ি বড়-বড় গাছে ঘেরা। এইসব গাছেরা অনেক অনেক পুরুষ ধরে মানুষের ইতিহাস জানে।
জরুলের জোয়ান বয়সের অনেক কথাও জানে। জরুল গাছগুলার দিকে তাকায়, মনে মনে হাসে।
আলেয়ার হাত ধরে এই পথেই সে প্রথম এসেছিল অজানার আহ্বানে। গাছগুলার মুখে ভাষা থাকলে
এখন ঠিক জিজ্ঞেস করে ফেলত কত কথা। জরুল
মনে মনে হয়তো কুশল বিনিময়ও করে নেয় । কিন্তু আর বেশি পথ বাকি নেই। অন্ধকার প্রায়
নেমে এল বলে। এই জায়গাটায় দুইপাশে জঙ্গল চিরে পায়ে হাঁটার পথ হলেও পাহাড়ি সাপ আর
বন্য জানোয়ারের অভাব নেই। পিপাশার কথা ভুলে জরুল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। এখন
জীবনের মায়া নেই এইরকম একটা ভাবনা বিগত কিছুদিন তার মনে ঘুরঘুর করলেও এই প্রথম
জরুল টের পেল তার জীবনের মায়া ঠিক আগের মতোই টনটনে।
পথ যেখানে শেষ ঠিক তার
মুখেই উচমং মোবাইলের টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে জরুলের জন্য। এখন অন্ধকার আরও
গাঢ় হয়ে এসেছে। কিন্তু জরুলের হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের আলোয় উচমং টের পান জরুলের
আগমনের। এই পথে খুব ঠেকায় না পড়লে এই সময়ে কেউ আসা যাওয়া করে না। উচমং জরুলকে বুকে
জড়িয়ে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। দু’জনেই বাচ্চা ছেলের মতন জড়াজড়ি করে কাঁদে। অনেক বছরের
অনেক স্মৃতি। উচমং-এর বউ মারমা ভাষায় তার স্বামীকে ডাক দেয়। তাদের ঘর মাচাংয়ের। বড়
মোটা পাহাড়ি গাছের খুঁটি আর বাঁশ, বেড়ার ঘর। দেখতে খুব সুন্দর। ঘরের সঙ্গে লাগানো
সামনের দিকের মাচায় ঘরের ভেতরের সোলার বাতির আলো এসে পড়ে। মাথার উপর দূরে পাহাড়সারির
কপালে একটা টিপের মতো হলদে চাঁদ ঝুলে আছে। জরুল সামনের দিকে মাচাংয়ে উঠে বসে পড়ে।
কলসিতে রাখা পানিতে পা ধুয়ে নেয়। উচমং একটা কাপড় এগিয়ে দেয় হাত-মুখ মোছার জন্য।
একটা পাহাড়ি পানির পাত্র এনে দেয় তারপর। জরুল সাধুদের মতো করে ঢকঢক করে গলায় পানি
ঢালে। নিজের চোখ বুজে নেয়। তারপরই ‘আহ’ বলে একটা শব্দ করে উঠে। উচমং হাসি-হাসি মুখ
করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘বড় স্বাদ গো দাদা!’
‘স্বাদ হবে তো, ঝিরির
পানি তো।’
‘আহারে দাদা! আলেয়া এই
ঝিরির পানি খাইতে কত না পছন্দ করত!’
একটু নড়েচড়ে বসতে গেলে
জরুল টের পায় তার পায়ের ব্যথা। সত্যিই তার বয়েস হয়েছে। উচমং হেসে উঠে হো হো করে।
‘আরে জরুল ভাই, এখন
তোমার কথা কি বলব, আমি নিজেও আর বেশি পাহাড় বাইতে পারি না।’ হেঁটে আসার কারণে শীতের প্রভাব টের পায়নি জরুল। এখন বেশ বুঝতে পারছে ভীষণ
করে শীত পড়ছে। উচমং তাদের ঘরে বোনা একটা বাহারী রঙের শাল এনে দেয়। জরুল ব্যাগ খুলে
সোয়েটার পরে তার উপরে শাল পেঁচিয়ে নেয়। পায়ের ব্যাথাটা সে এখন আরও বেশি করে টের
পাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে বা শীতে কোনওকালেই কম নেই, এই সময়টা উচমং পাহাড়ি দো চুয়ানি
বা হাতের কাছে পেলে এলাচি মদে নিজেকে ভিজিয়ে নেয়। নিজেদের ঘরে বানানো জিনিস। সমতলে
জরুল এই রকম সময়ে তেমন কুয়াশা দেখে না। কিন্তু পাহাড়ি এই জনপদে শীতের সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে প্রায় ঘন কুয়াশা নেমেছে। বয়সের
কারণেই হয়তো জরুলের ভারী কাপড়ের ভেতর দিয়েও শীত হাড়ে গিয়ে লাগছে। নীচে মাচাঙ্গের
তলে পোষা শূকরের ঘোঁত-ঘোঁত শব্দকে ছাপিয়ে উচমং জরুল কে এলাচি মদ খাবার জন্য আবেদন
জানায়। জরুল জিহ্বায় কামড় দিয়ে হ্যাঁ বা না-র মাঝামাঝি কিছু একটা বলতে চায়। উচমং
এর ঘরণী ততক্ষণে এক বোতল মদ আর দুটো ছোট কাচের গ্লাস এনে দেয়। সঙ্গে ঝাল করে
রান্না করা বনমুরগির মাংস। অনেকদূর হেঁটে আসার কারণেই জরুলের খিদেটা আগে থেকেই
মাথা চাড়া দিয়ে আছে। সে দেরি না করে এক টুকরো মাংস হাতে তুলে চাবাতে শুরু করে।
মদের বোতলের থেকে কয়েক ফোঁটা মদ বোতলের ছিপিতে নিয়ে দরজা দিয়ে ঘরের বাইরে ছুড়ে
ফেলে। এটা প্রথাগত। অতৃপ্ত আর মৃত আত্মাদের জন্য ছুঁড়ে দেওয়া হয়। গ্লাস ধুয়ে উচমং সমান করে গ্লাসে মদ ঢেলে নেয়। গ্লাস উঁচু
করে দু’জনেই ছোট্ট করে টুং শব্দ করে। দূরে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে ওঠে। পাশের কোনও ঘর থেকে একটা পাহাড়ি শিশু কেঁদে উঠে। কয়েক চুমুক
কোনও কথা না বলেই দু’জনেই খেয়ে নেয়।
পাহাড়ি মদের ঝাঁঝ একটু
বেশিই কড়া। তার উপর কোনওরকম পানি না মিশিয়ে এক প্যাগ করে দু’জনেরই গলায় নেমেছে। কানের গোড়া গরম হয়ে যায় তাতে। জরুল উচমংকে উদ্দেশ্য করে
বলে, ‘কথায় বলে পুরুষের শীত কানে, নারীর শীত রাণে’। উচমং আবার হো হো করে হেসে উঠে,
‘ঠিক বলছ দাদা’। জরুল বোধ করে তার শীত আগের চেয়ে কমে আসছে। সেই দুপুর থেকেই উচমং
অপেক্ষা করেছে কিন্তু এক গ্লাস মদে তার সেই উৎকণ্ঠার রেশ যেন এতক্ষণে পড়ে গেল। এবার
মদের কারণেই হোক আর আলাপের মেজাজেই হোক আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে গেল। নতুন করে গ্লাসে মদ ঢালতে গিয়ে উচমং বলে
ওঠে, ‘বাচ্চার কান্না শুনছ না একটু আগে জরুল দাদা?’
‘কোন বাচ্চার কান্না?’
‘এই কতক্ষণ আগেই তো একটা
বাচ্চা কাঁদছে, শুনো নাই জরুল দাদা?’
জরুল মনে করার চেষ্টা
করল। সে হয়তো খেয়াল করে নাই। ঠিক
জরুলকে শুনাবার জন্যই হয়তো তখনই বাচ্চাটা আবার কেঁদে উঠল। মনে হল দু’-এক ঘর পরেই
কোনও একটা ঘর থেকেই বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। পাহাড়ের ঝিঁঝিরা সেই কান্নার
শব্দ জরুলের কানে দেবার জন্যই দু’-এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে আবার আগের গতিতে বেজেই
যাচ্ছে। জরুলের মনে হল এটা হয়তো প্রকৃতিরই ইচ্ছা। নাহলে বাচ্চার কান্নার সময় ঝিঁঝির
ডাক থেমে যাবে কেন? এইসব ভাবনার মাঝেই উচমং আবার গ্লাসের এক চুমুক মদ গলায় ঢেলেই বলে
উঠে, ‘জরুলদাদা, এইটা তোমার নাতনি।’ জরুল
এতটাই অবাক হল, গ্লাসে চুমুক দিতেই ভুলে গেল। তার হাত বুকের কাছাকাছি এসে থেমে গেল। ‘আমার নাতনি? আমার? কোন সময় জন্মাইছে দাদা?
কই কিছু তো বলো নাই? একটা মোবাইল তো করতে পারতা?’ এইবার উচমং অপরাধীর মতো মাথা
নীচু করে বলে, ‘দাদা, আমি খবর দিতে চাইছিলাম। কিন্তু তোমার ছেলে খবর দিতে মানা করল!
আমিও ভাবলাম কিছুক্ষণ পরেই নাহয় খবরটা দাদাকে দিব। কিন্তু মোবাইলের টাকা শেষ হইছে খেয়াল ছিল না। পরে ভাবলাম তুমি তো আসবা ফোন
দিছ।’ জরুল কেবল ও শব্দটি করলো। আর-একটা
চুমুক দিয়ে উচমং বলে, ‘নাতনি তো দেখতে আলেয়াদিদির মতন সুন্দর, খুব সুন্দর দাদা।’ আলেয়ার কথা উঠাতেই, নাকি মদের নেশায়, নাকি নিজের বংশের
নতুন মুখের আগমন সংবাদে কে জানে জরুলের চোখে পানি চলে আসে। মানুষেরা এক অদ্ভুত
প্রাণী। এরা ছোটবেলা আর পড়ন্ত বুড়োবেলায় কারণে-অকারণে কাঁদতে পারে। জরুল কাঁদলে
উচমং আবার বিব্রত হয়। আর-একটা নতুন প্যাগ সে নিজের জন্য সাজায়। জরুল এবার লুঙ্গির
কোনা দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে গ্লাস এগিয়ে দেয় উচমং-এর দিকে, ‘আচ্ছা উচমং দাদা,
সত্যিই আলেয়ার মতো হইছে?’
‘আরে, সত্যি মানে, কাল সকালে দেখবে বুঝবা দাদা!’
জরুল নড়েচড়ে বসে। তার
খুব করে আলেয়ার কথা মনে আসতে থাকে। মদের নেশাটা মাথার ভিতরে ঘুরপাক দিয়ে উঠে।
আলেয়ার স্মৃতি সাঙ্গুর হড়কা বানের মতোই তার মনের দুই কূল ছাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জরুল
উচমংকে বলে, ‘দাদা, নাতনিকে এখন দেখতে মন চাইতেছে।’ উচমং তাকে থামিয়ে দেয়। ‘আরে না, বেলা থাকতে আসলে দেখা হইতো। কালকে সকালে ঘুম
থেকে উঠে তারপর দেখবা না হয় দাদা’! উচমং জানে জরুলের ছেলে আলম তার বাবাকে পছন্দ
করে না। সে তার বাবার ছায়াটাও মাড়াতে রাজি না। এখন এই রাতের বেলা তার ঘরে জরুলকে
নিয়ে গিয়ে কোনও বাজে অবস্থার মাঝে উচমং আর নিজেকে জড়াতে চায় না।
জরুলের ছেলে আলম বিয়ে
করেছে এক পাহাড়ি মেয়েকেই। আলম বড় হয়েছে উচমং-এর ঘরেই। নিজের ছেলের মতো করেই বড়
করেছে আলমকে উচমং ও তার সন্তানহীনা বউ। সেসব অনেক কথা জরুলের মনে এখন উথালপাতাল করে ভেসে যাচ্ছে। একটু করে মদের
গ্লাসে চুমুক দেয় আর সেই ঝড় আরও বাড়তে থাকে।
জরুলের বাপের বাড়ি ছিল
পদ্মার ওই পাড়ে কোনও এক গ্রামে। তার বাপ ছিল কামলা। সেও বাপের মতোই কামলা দিতে
যাইত মানুষের জমিতে। পাঁচ ক্লাস পড়া জরুল একদিন মণ্ডলবাড়ির কামলা দিতে গিয়ে তাদের
ঘরের এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে যায়। এভাবে বললে আসলে ভুল বলা হয়। সেই কিশোরীই জরুলের
সটান পেশি আর মাথার বাবরি চুলে পাগল হয়ে ঘর পালায়। জরুলের সেই কাহিনি আর-একটা
গল্প। পালিয়ে প্রথম ঢাকা শহর যায়। একটা বস্তিতে ওঠে। টিকেট কেটে রাজ্জাক-শাবানার
ছবিও দেখে একদিন। সেই ছবিতে সাগর আর পাহাড়ের সিন দেখে জরুলের কাছে আবদার করে
আলেয়া, তাকেও পাহাড় আর সাগর দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। প্রেমিকের মন, বউয়ের আবদার
রক্ষায় সেই যে ঢাকা শহর ছাড়ে প্রথমে সমুদ্র দেখে। তারপর ফিরতি পথে পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সেখানেই থেকে যায়।
সেই সময় তারা চিম্বুক
পাহাড়ে ঘুরতে আসে। পাহাড়ের গায়ে তখন মেঘের খেলা। মেঘের ভেতর থেকে তারা তাকিয়ে
দুনিয়া দেখে। জরুল আর আলেয়া অবাক হয়ে দেখে। আলেয়া জরুলকে বলে এইখানে যদি কোথাও
থেকে যাওয়া যাইতো। তরুণ জরুলও সেই ভাবনায় মজে যায়। ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। আর তাই
বিধাতাও আছেন বটে। নাহলে সেই সময় সেই পথে উচমং আর তার নবীন বউ গ্যালেঙ্গা যাবার
জন্য এই চিম্বুকেই কেন থাকবে? যাত্রাবিরতিতে আলেয়া আর উচমং-এর বউ কি আলাপ করে কে
জানে। তারা এই বাঙালি নবদম্পতিকে
নিজেদের ঘরে বেড়াতে নিয়ে যেতে রাজি হয়ে যায়। সেই বেড়ানোই শেষে নানান ঘটনায় পাহাড়েই
স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় তারা। উচমং সহজ-সরল পাহাড়ি। তার বাবা-মা ততদিনে গত হয়েছে।
বাবা গ্রামের কারবারি ছিল, প্রথাগত ভাবেই সেও কারবারি। জরুলের পাহাড়ে আবাস গড়তে প্রথমে কিছু বাধা আসলেও পরে সবাই কেন যেন সেটা মেনেও
নেয়। জরুল-আলেয়ার সংসার শুরু হয় সেই পাহাড়ি সাঙ্গু নদীর তীরে গ্যালেঙ্গা গ্রামে। পাহাড়ি
ঝিরির কাছেই একটা কুঁড়ে ঘর বাঁধে জরুল। এখানে পাহাড়ি বন যেমন অন্য প্রাণীকে বাঁচিয়ে
রাখে, মানুষকেও হতাশ করে না। সেই
জঙ্গল থেকে গাছ কেটে ঘর বাঁধে জরুল। আলেয়া সেই ঘরে আলোর মতোই ছিল। মারমা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে সাঙ্গু তীরের পাহাড়ের ঢালে
জুম চাষ করে রূপকথার গরিবের বড়লোকি সুখের মতোই দিন কাটছিল। তাদের ভালোবাসার ফসল
আলম আসল দুই বছর পর। এতগুলান পাহাড়ি বাচ্চাদের মাঝে আলম যখন ছোট থাকতে খেলে বেড়াত,
তাকে টারজানের মতোই অচিন আর ভিনদেশি লাগত।
মাঝখানে সেই বছর বর্ষার শেষের দিকে, আলেয়া বেগমের যখন সংসারের মায়া বেড়ে গেল, কোথা
থেকে যেন এক বিকেলে মরণের জ্বরে ধরল তাকে। আলম তখনও বুকের দুধেই বড় হচ্ছিল। সারারাত
জরুল বউয়ের চামড়া জ্বলে যাওয়া জ্বরের কষ্টে পাগলের মতো সকালের জন্য অপেক্ষা করছিল।
যেন সকাল আসলেই রোদের আলোতে আলেয়ার জ্বর ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু পাহাড়ি এলাকা,
দুর্গম সেই পথ। দিনের বেলাও যে তফাত করে তাও না। দুইদিন পার হলেও হাসপাতাল বা
ডাক্তার পাওয়া যাবে না নিশ্চিত। ভরসা পাহাড়ি চিকিৎসা। তাতে কোনও কাজ হল না।
সারাদিন সেদিন আকাশভাঙা বাজের সঙ্গে অবিরত বৃষ্টি হল। গ্রামের পাশেই সাঙ্গু নদীতে তুমুল স্রোতে দূর বহুদূর পাহাড় থেকে ভেসে আসল কত
গাছপালা। আলেয়ার প্রাণটাও সেই ঝিম ধরা বর্ষার বিকেলে সময়ের স্রোতে জরুলের অচেনার
বাইরে চলে গেল।
প্রেমের টানে ঘর ছাড়া
জরুল আলেয়াকে হারিয়ে সেই দুধের ছেলেকে উচমং-এর বউয়ের কোলে তুলে দিল। সেটাই সবচেয়ে
ভালো ছিল। আর উপায় বা কী ছিল। আলম
যেভাবে অজানা কারণে এই পাহাড়ে সংসার বেঁধেছিল সেই অজানা কারণেই সেই সংসার ত্যাগও
করল। উচমং নিজ ভাইয়ের মতো তাকে অনেক বোঝাল ঠিকই,
কিন্তু একদিন সূর্য ওঠার আগেই গ্যালেঙ্গা ত্যাগ করেছিল জরুল।
আলম বড় হল উচমং-এর ঘরে।
সেই সুবাদে সে কিছুটা বাংলা ও পুরোপুরি মারমা দুই ভাষাতেই কথা বলতে শিখল। এখানকার
আদিবাসীদের সঙ্গে সে-ও বড় হল। বাপের
মতো পাঁচ ক্লাসের বেশি আগানো হল না তার। পাহাড়ে এর চেয়ে বেশি পড়তে পারাটা ভাগ্যর
ব্যাপারও বটে। মায়ের কথা মনে পড়ে না তার। বাবাকেও চিনতে পারত না। যদি না জরুল
বছরকয়েক পরপর আলেয়ার কবর আর তার ফেলে যাওয়া ছেলেকে দেখতে না আসত। কিন্তু একটু বড় হয়ে বুঝতে পারল যে সে দেখতে আর সবার মতো
না। অন্য পাহাড়ি বাচ্চারা সেটা তাকে বুঝিয়ে দিত নানানভাবেই। সেইসব কোনও এক গভীর
মনোগত কারণে সে তার বাবাকে চেনার পরেও ঘৃণা করে।
উচমংকেই সে বাবা ডাকে।
সেই সুবাদে এক সুন্দরী পাহাড়ি মারমা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়েও হয়। সেই ঘরের নাতনির
কান্না শুনে এখন আলম নতুন করে ভাবছে, ফিরে ফিরে দেখছে তার স্মৃতি। কয়েক গ্লাস মদের
নেশায় বুঁদ হয়ে আর সারাদিন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার কারণে জরুল আগে থেকেই ক্লান্ত
ছিল। উচমং-ও জরুলের চেয়ে বেশি পান করে যে হুঁশে ছিল তা নয়। সামনে খাবার দেওয়া হল। খেয়েই পাশে বিছানাতে শুয়ে এক ঘুমে রাত পার করে দিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখলো ঘন কুয়াশা। গায়ের
জামাকাপড় নিয়েই ঘুম থেকে উঠে পাশে থাকা পানির ঘটি থেকে দুই ঢোক খেয়ে নেয়। দাঁতের মাঝে
শিরশির করে উঠে। জরুল বাসিমুখ নিয়ে ঘরের মাচাং-এর উপর দরজার কাছে বসে পড়ে। উচমং-এর
বউ একটি সিলভারের জগে করে পানি নিয়ে আসে হাত-মুখ ধুয়ে দেওয়ার জন্য। জরুল বিনয় করে
বলে, ‘কষ্ট দিতেছি দিদি। উচমং দাদায় কই?’ উচমং-এর বউ বাংলা বলতে পারে না খুব একটা,
তবে বুঝে। উত্তর করে, ‘না, কস্ত নাই দাদা! খুশি আছে আমি’। আর পাহাড়ি ভাষায় যা বলে তার মানে একটু পরেই নাস্তা দিবে। নাস্তা বলতে গরম
জুমের চালের ভাত, গতরাতের বাসি মুরগীর মাংস, আলুভর্তা আর সাঙ্গু থেকে পাওয়া কড়া
মাছভাজার সঙ্গে পাহাড়ি ঝাঁঝালো মরিচ আর অতি অবশ্যই নাপ্পি।
জরুল বাসিমুখেই দরজায়
বসে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। আরাম করে সেটি খেয়ে মুখ ধুয়ে নেয়। নাস্তা খাবার
আগেই উচমং কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয়। বুঝাই যাচ্ছে অনেক ভোরেই সে ঘুম থেকে
উঠেছে। হাতে একটা তিন-চার কেজি ওজনের বোয়াল মাছ। উচমং-এর আয়োজনে জরুল লজ্জা পেয়ে
যায়। সে যতবারই আসে কিছুই নিয়ে আসে না। একবার জরুল তার ছেলের জন্য শখ করে জামা আর
সঙ্গে লালরঙের একজোড়া জুতা এনেছিল। কিন্তু
সে নিয়ে এসে দেখে তার ছেলে তার ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি বড় হয়ে গেছে। সেবারও সে খুব
লজ্জা পেয়েছিল।
উচমংকে পেয়ে জরুল জানায়
সে আলেয়ার কবর দেখতে যাবে। উচমং বলে ‘আগে নাস্তা করে নাও দাদা পরে যাই।’ আলম রাজি হয় না। সে
আগেই যাবে। সেজন্য সে সাঙ্গুতে নেমে গোসল দেয়। পাথুরে নদী, খুব স্বচ্ছ তার জল। তবে
এই সময়ে নদী থেকেও কুয়াশার আস্তরণ উঠতে থাকে। জরুল জানে এই শীতে নদীর নীচের দিকের
পানি গরম থাকে। গোসল করাতে জরুলের শীত অনেক কমে যায়। সে সোজা আলেয়ার কবরের কাছে
চলে যায়। একটা জারুল গাছ আলেয়ার মাথার
দিকে ঠিক উপরে উঠে গেছে। সেখানে বসন্তে ফুলে-ফুলে ভরে যায়। কয়েক বছর আগেই জরুল
যেবার শেষবার এসেছিল তখন কবরের বেড়া দিয়ে গিয়েছিল। এখন সেখানে ভাঙা খুঁটি আর বাঁশের পচে যাওয়া টুকরো। জরুল আলেয়ার কবরের পাশে
হাঁটু গেড়ে বসে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে কবরের গায়ে হাত বুলায় এমন ভাবে যেন
শুয়ে থাকা আলেয়ার চুলে বিলি কেটে দেওয়া। এরপর দুই হাতে খাবলা করে মাটি এনে সেই
কবরের উপর নতুন মাটি দিতে চেষ্টা করে। উচমং দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে। ফিরে এসে দু’জনে নাস্তা করে নেয়। এরই মধ্যে একবার আলমকে
উচমং-এর ঘর থেকে দেখতে পায় জরুল। একবার ডাকতে গিয়েও জরুলের গলার কোথায় যেন বাধা
পড়ে। কিছুক্ষণ পরে উচমং ঘরের ভেতর থেকে এসে আলমের হাতে একটি রুপার তাবিজের গলার
মালা এনে দেয়। জরুল নিতে চায় না। কিন্তু উচমং তাকে জানায় এইগুলা আলেয়ার ছিল। আলমের বিয়ের সময় এই হারটি ছাড়া আর সব তার
ছেলের বউকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নাতনির মুখ তো আর খালি হাতে দেখতে যাওয়া যায় না।
এইসব বুঝাতে থাকে জরুলকে। জরুল বারবার লজ্জায় পড়ে যায়। একদিন এই জনপদে তারও ঘর-সংসার
ছিল। অথচ এখন তার বংশধরেরা আছে। কিন্তু সে কেমন যেন খাপছাড়া এখানে, মেহমান। নাতনির
মুখ দেখতে গেলে আবেগে আর-একবার কেঁদে ফেলে সে। চারদিনের বাচ্চা কি বুঝে যেন দাদার
কোলে উঠেই মুখ হাসি-হাসি করে রাখে, হাত-পা ছুঁড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। জরুল নাতনিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে আদর করে। তার মাথায়, হাতে-পায়ে,
গালে চুমু দেয়।
উচমং এবারও নানারকম
অনুরোধ করে জরুলকে থেকে যাবার জন্য। এই বয়সে সে চাইলে অনায়াসে এই পাহাড়ি জনপদে
নিজের ফেলে যাওয়া রক্তের কাছে থেকে যেতে পারে। তার নাতনির মুখে সে আর-এক আলেয়ার
ছায়া দেখেছে। তার খুব মায়া হয়। জীবন তাকে বাঁধতে চায় অজানা মায়ায়। সে কয়েকবার
আলমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবার আলম এড়িয়ে গেছে, হনহন করে হেঁটে চলে
গেছে। জরুল একবার ‘বাপজান’ বলে ডাক দেওয়াতে আলম উল্টা করে দাঁড়িয়েছিল। জরুল বলে, ‘বাপ
হিসেবে আমারে ঘেন্না করস জানি, কিন্তু একজন অচিন মানুষ মনে কইরাও তো আমার লগে কথা
বলতে পারস।’ আলম
উত্তর না দিয়ে আবার হেঁটে চলে যায়।
এই যাত্রায় জরুলের দু’-তিনদিন
থাকার পরিকল্পনা থাকলেও এক সপ্তাহ থেকে যেতে হয়। আলম তার বাবার সঙ্গে একটা কথাও
বলে না। ছেলের বউ তাকে যথেষ্ট সমাদর করে। জরুলও নাতনিকে নিয়ে প্রায় সারাক্ষণ কোলে
নিয়ে খেলা করে। আর মাঝখানে দুইদিন জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে এনে আলেয়ার কবরের বেড়া সে
নিজহাতেই আবার লাগিয়ে দেয়। নতুন মাটি এনে কবর উঁচা করে। সেদিন সন্ধ্যায়ও জরুল আর
উচমং এক বোতল পাহাড়ি মদ নিয়ে বসে। রোজকার মতো খাবার খেয়ে দু’জনেই শুয়ে পড়ে। কিন্তু
জরুল আজ আর মদের নেশায় ঘুমায় না। সে জানে এইখানে আর তার কোনও কাজ নেই। এইখানে তার
অতীত আছে, তার ছেলে আর ছেলের বউ আছে। আলেয়ারূপী নাতনি আছে । আলেয়ার কবরও আছে।
কিন্তু এই আছে বা নাই এই হিসাবে জীবন কেবল মায়াই বাড়ায়। জরুল দয়ামায়াহীন নয়। তবু
জীবনের আরও কোন গভীর টানে সেইদিন খুব ভোরে ঘন কুয়াশা ভেদ করে পাহাড়ি পথে জরুল আবার
অজানার উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়ায়। সে নিজেও জানে না এই পথে আবারও কি ফিরতে পারবে সে
আর কখনও? কেউ টের পায় না জরুলের চলে যাওয়া, কেবল তার নাতনি তার চলে যাবার সময় সেই
কুয়াশা মাখা অন্ধকার ভোরে হঠাৎ কেঁদে উঠে।
No comments:
Post a Comment