বাক্‌ ১৩৯ ।। ইয়ারফোন ।। রিপন হালদার




ইয়ারফোন

স্যার! আজকাল আমি কানে কম শুনতে পাচ্ছি।’’
হুম। কী করেন?
তেমন কিছু নয়। হকারি।’’
কীভাবে বুঝলেন?
সকাল ছটা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত আমি লোকাল ট্রেনে বাদাম বিক্রি করি। তারপর কাঁচরাপাড়ার ভাড়ার খোপে ঢুকি। আর প্রায় প্রতিদিনই মায়ের জন্য কিছু ওষুধ কিনতে হয়...
ধান ভানতে শিবের গীত করছেন কেন?
সরি।’’
ডোন্ট বি। আপনি আমাকে বলুন যে, কবে থেকে কীভাবে বুঝলেন যে আপনি কানে কম শুনছেন?
         আজ সকাল থেকে।’’
কীভাবে?
সকালে হেডফোনটা কান থেকে বের করতেই চারপাশ আগের থেকে কেমন যেন শান্ত বলে মনে হল।’’
বাহ্‌! এই তো! তা কতক্ষণ শোনেন?
কাজ না থাকলে আমি প্রায় সব সময়ই এটা কানে গুঁজে দিয়ে বসে থাকি। ফুল ভলিউমে।’’
উত্তম করেন। লেখাপড়া জানেন?
মাধ্যমিক দিয়েছিলাম। পাশ করিনি’’
বেশ। ইংরেজি পড়তে পারেন?
অল্প-স্বল্প’’
ওতেই চলবে। মোবাইলটা সঙ্গে এনেছেন?
হ্যাঁ’’
বের করুন!
         এই যে! বলে একটা পুরনো সস্তা স্মার্টফোন রোগী বের করল।
মিউজিক প্লেয়ার অন করুন! আর ইয়ারফোনটা কানে গুঁজুন!”
ইয়ারফোন মানে?
আপনি যাকে হেডফোন বলেন।’’
হ্যাঁ করছি।’’
ঠিক আছে। এবার সাউন্ড ভলিউম বাড়ান। বাড়াতেই থাকুন। মোবাইলের ডিসপ্লেতে লক্ষ করুন... কী লেখা আছে? দশের বেশি ভলিউম কানের পক্ষে ক্ষতিকর।’’
ডাক্তারবাবু! আমার কী হবে? আমি তো সবসময় ফুল ভলিউমেই শুনি!
কিচ্ছু হবে না।’’
কার?
আপনার কানের। কোন চিকিৎসা নেই।’’
কী বলছেন!
ঠিকই বলছি। চোখের কর্নিয়া নষ্ট হলে ঠিক হলেও হতে পারে। কিন্তু কান নয়। এরকম ভলিউমে গান শুনতে থাকলে এক সময় আপনি সম্পূর্ণ বধির হয়ে যাবেন।’’
ডাক্তারবাবু! কোন চিকিৎসাই কি নেই?
আছে। এখনো। একটা মাত্র উপায়।’’
কী?
গান শোনা বন্ধ। মানে আপনার ইয়ারফোনে।’’
ওটাই তো আমার একমাত্র ইয়ার ডাক্তারবাবু!”
তাহলে থাকুন আপনার ইয়ার নিয়ে। এখানে আর আসবেন না।’’
                          
বিরক্ত, ভীত আর অসহায় ভাবে শ্যামল হাসপাতাল থেকে বেরল। একটা ব্যাপার নিশ্চিত। ইয়ারফোনে গান শোনা বন্ধ। ভেবে দুঃখ পেল শ্যামল। চল্লিশ বছরের জীবনে ঘরে ওর একমাত্র সঙ্গী বৃদ্ধা মা। শয্যাশায়ী। পৃথিবীর সমস্ত কঠিন রোগ নাকি মায়ের শরীরে বাসা বেঁধে আছে। আয়ের বেশিরভাগটাই চলে যায় মায়ের ওষুধ আর চিকিৎসায়। এটা সারে তো ওটা শুরু হয়।
সারাটা দিন শ্যামলের কাটে ‘বাদাম, বাদাম’ বলে চিৎকার করে। তখন আর কোন শব্দই ওর কানে ঢোকে না। খদ্দেরের ডাক ছাড়া। তিনটে পাঁচে আপ শান্তিপুর লোকাল থেকে ও কাঁচরাপাড়ায় নামে। ঘরে ঢুকে রান্না চড়িয়ে দিয়ে চান করতে ঢোকে। মাকে খাওয়ানোর পর নিজে খেতে খেতে চারটে বেজে যায়। মাকে ওষুধপত্র খাইয়ে তারপর ও ইয়ারফোনটা কানে গোঁজে। শুয়ে শুয়ে গান শোনে। দরজাজানলা বন্ধ করে। ঘর অন্ধকার নাহলে ওর গান শোনায় মুড আসে না। এই সময় ওর মায়ের কোঁকানি, হা-হুতা আর দীর্ঘশ্বাসগুলো কুমার শানুর ভারীণ্ঠেনীচে চাপা পড়ে থাকে।
সেদিন ব্যারাকপুর লোকালে কামরায় ঢুকেই ‘বাদাম, বাদাম’ বলে চিৎকার শুরু করেছিল। হঠাৎ চুপ করে গেল। গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিল একজোড়া যুবক-যুবতিযুবতি তার ডান হাতটা যুবকের কানের কাছে নিয়ে নাড়াচ্ছিল। ফর্সা বাহুতে প্রায় কনুই পর্যন্ত সবুজ কাচের চুড়ি। সেই চুড়ির শব্দ শোনাচ্ছিল যুবককে। শ্যামল দৃশ্যটা দেখল। দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথা নীচু করে শ্রবণশক্তিকে একটা বিন্দুতে এনে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল চুড়ির ওই শব্দগুলো শুনতে। যদিও ট্রেন চলার আর যাত্রীদের কথার বিকট শব্দ বারবার ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। তবু ওই ছেড়াখোঁড়া শব্দ নিয়েই খুশি ছিল শ্যামল। ওর অক্ষম দুর্বল কান ওকে আর কতই বা সাহায্য করতে পারে! চলমান ভিড়ের মধ্যে স্থির হয়ে গিয়েছিল শ্যামল। এর ফাঁকে পিন্টু ঢুকে পড়েছিল ওর কামরায়। ওরটাই বিক্রি হলশ্যামল নেমে গেল পরের স্টেশনে।

আবছা পিএল ল্যাম্পের নীচে একটা খাটিয়া। তেলচিটে বিছানার উপর শুয়েশুয়ে মোবাইলটা দেখছে শ্যামল। ইয়ারফোনটা এমনি কানে গোঁজা। গান চালায়নি। পাশের ঘর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ। শ্যামল ওঠে। মায়ের বেডপ্যান পরিষ্কার করতে হবে।
পরদিন শান্তিপুর লোকাল। বাদাম, চানাচুর, জল, মোজা, সেফটিপিন, পোড়া আমের শরবত নিয়ে হকারদের মহাসম্মেলন। চিৎকার-আনন্দ-হুল্লোড়-রসালাপ আর ট্রেন চলার ভয়ংকর শব্দ মিলেমিশে দক্ষযজ্ঞ বেধে গেছে। এত শব্দ! শ্যামল ঘাবড়ে যায়। তার মানে আপাতত ওর কান তো ঠিকই আছে! তাহলে হাসপাতালের ডাক্তার ওর সঙ্গে রসিকতা করল! ডাক্তাররাও রসিক হয়! কোন পরীক্ষা-টরীক্ষা না করেই বলে দিল ওর কান খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
যুবক থেকে মধ্যবয়স্ক প্রায় সব যাত্রীর কানেই ইয়ারফোন। বড়-বড় শ্লেটের মতো মোবাইল। সঙ্গে ইয়ারফোনের সাদা অথবা কালো লেজ দুভাগ হয়ে দুই কানে উঠে গেছে। অন্য হকাররা চলে যেতেই শ্যামল ইচ্ছে করে অন্য দিনের চেয়েও অনেক জোরে ‘বাদাম’ বলে চিৎকার করে উঠল। কয়েকজন যাত্রী কেঁপে উঠল হঠাৎ। ঘুম জড়ানো চোখ অর্ধেক খুলে গেল কারও। কেউ তাকাল খুনির দৃষ্টিতে। শ্যামল মজা পেল। এই সুখের দুলুনি একটিমাত্র শব্দে ভেঙে দিয়ে। অবশ্যই ওখানে আর বিক্রি হল না। আজ চার ঘণ্টায় মাত্র এক চেইন বাদাম বিক্রি হয়েছে। মালিককে দিয়ে ওর কী থাকবে! মায়ের ওষুধের কী হবে! এভাবে চলতে থাকলে মাসের শেষে ঘরভাড়া বা শোধ করবে কীভাবে!

বিরাট একটা ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে শ্যামল নেমে গেল শ্যামনগরে। মাকালীর মন্দিরে একটা পুজো দিয়ে আসবে।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মশাই ধর্মে বিশ্বাস নাই মন্দিরের পুরোহিত কথা প্রসঙ্গে বলে ওঠেন।’’
হুম। তাহলে বিশ্বাস কিসে? শ্যামল জানতে চায়।’’
কেন, মোবাইল আর জিনসের প্যান্টে! ফোকলা দাঁতে হাসেন পুরোহিত।
হ্যাঁ! কী যে বলেন!
ঠিক কিনা বলেন?
ঠিক। কিন্তু বিয়ে তো ভালোই হয় আপনার এখানে। প্রতিদিন পাঁচ-ছটা করে... এত চলছেই একনাগাড়ে।’’
এবার একটু দমে গিয়ে পুরোহিত বলেন, ‘‘কথা সেটা না। এখন তো দিব্যি চলে যাচ্ছে! আমি বলছি ভবিষ্যতের কথা। ছেলেমেয়েরা তো আজকাল বিয়েই করছে না। অথচ একসাথে থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের সংসার চলবে কী করে বলতে পারেন?’’
হুম। এটা একটা ভয়ংকর সমস্যার ব্যাপার।’’ পুজোর প্রসাদটা হাতে নিয়ে শ্যামল বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়।

সিমেন্টের চাতালে লাইন দিয়ে চার-পাঁচটি বিয়ে। বর-বউ সেজে বসে আছে ছেলেমেয়েরা। চার-পাঁচটা যজ্ঞের আগুন। খই পুড়ছে। কুলো থেকে ঝরছে জুঁই ফুলের মতোসামনে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী। তার গায়ের শাড়ি, সিঁদুর, শরীর মিলেমিশে একটা আনকোরা গন্ধ।
শ্যামল চোখ ফিরিয়ে নেয়। গঙ্গা এখানে বেশ প্রশস্ত। সেখানে কত মানুষের মৃত আর সজীব নিশ্বাস তরল হয়ে আছে।
রদিন সকালে ইছাপুর স্টেশনে সিমেন্টের চেয়ারে বসে আছে শ্যামল। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা কী চকচকে পোশাক পরে সকালের আলোর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে! মেয়েদের ঠোঁটে, চোখে, চুলে কী সুন্দর রং! পিঠে ব্যাগ। কী আকর্ষক ডিজাইন তাদের! কী বৈচিত্র! জিনসের নীলরঙে কী ধার! চোখ ফেরানো যায় না। কী সুন্দর এই চলমান রঙিন মানুষের স্রোত! এবং প্রায় সবারই কানে ইয়ারফোন। গানকে সঙ্গী করে তাদের দিনের শুরুয়াত। শ্যামল শুধু এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। আচ্ছা! এদের কানে কোন সমস্যা হয় না! যত সমস্যা ওর!
শ্যামল দেখে চাপা ত্বক রঙের জিন আর টপ পরা একটি মাংসল শরীর ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ারফোনে কথা বলছে কার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগেই ট্রেন ছেড়ে গেছে বলে প্ল্যাটফর্মে ভিড় পাতলা। মেয়েটির থেকে দৃষ্টি সরে গেলে দেখা যায় সকালের উজ্জ্বল রোদ রেললাইনের ইস্পাতের উপর পড়ে চকচক করছে। লম্বা তলোয়ারের মতো এই দৃশ্যগুলো শ্যামলকে আহত করে। চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মোবাইল স্পিকার চালিয়ে দেয় জোরে ‘দিলকা আলম ম্যায় ক্যা বাতাউ তুঝে...’

আপ শান্তিপুর থেকে নামল পিন্টু। পরের বগিতে উঠতে যাবে তখন চোখে পড়ল শ্যামলকে। ট্রেনে না উঠে শ্যামলের কাছে চলে আসে। বছর পঁচিশের এই ছেলেটিকে বেশ পছন্দ শ্যামলের।
কী শ্যামলদা! বসে আছো যে! আজ কাজ করবে না!
না রে। ভালো লাগছে না।’’
কেন? শরীর খারাপ নাকি?
না। তেমন কিছু না। এমনিই।’’
পিন্টু বসে পড়ে শ্যামলের কাছে। তারপর শ্যামলই প্রশ্ন করে, ‘‘আজ তোর বিক্রি কেমন?’’
ভালোই। প্রায় অর্ধেক মাল শেষ।’’
বাহ্‌! খুব ভালো।’’ অন্যদিকে তাকিয়ে শ্যামল উত্তর দেয়। তারপর গানটা অফ করে। পিন্টু আবদারের সুরে বলে ওঠে, ‘‘এই গানটা আমাকে দাও তো শ্যামলদা! আমি ব্লুটুথ অন করছি। আমার কাছেও ছিল। মনে হয় ডিলিট হয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছি না
এই মধু সিঙের বাজারে এসব গান আর ভালো লাগবে রে? মৃদু হাসে শ্যামল।
কী যে বলো তুমি! শানু আমার অলটাইম ফেবারিট। শানুর স্যাড সঙের কোন কথা হবে না।’’
এরপর একটু থেমে গম্ভীরভাবে শ্যামল বলে, সামনে দ্যাখ! আধ ঘণ্টা হয়ে গেল কথা বলেই যাচ্ছে। ফিগার দেখেছিস? মাথা ঠিক থাকে বল? মনে হয় না, জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলি! চোকলা সমেত!”
ঠিকই বলেছ। চাবুক দেখতে। আজকাল ট্রেনে-বাসেই হিরোইনরা ঘুরে বেড়ায়। সিনেমা দেখতে হয় না... কই গানটা দাও? ট্রেন তো এসে পড়বে!”
এখন থাক রে পিন্টু! পরে নিস! একটু থেমে দ্বিধাগ্রস্তভাবে শ্যামল পিন্টুকে বলে, তোর কাছে কিছু টাকা হবে?
কত?
দুশো হলেই হবে।’’
দিচ্ছি। দাঁড়াও।’’
পিন্টু প্যান্টের চোরাপকেট থেকে এক গোছা নোট বের করে। দুটো নোট শ্যামলের উদ্দেশ্যে তুলে ধরে, এই নাও
ঠিক আছে। সন্ধ্যাবেলা দেখা করিস!” বলে শ্যামল নোটদুটো বুক পকেটে রাখে।
এরই মধ্যে ডাউন রানাঘাট লোকাল স্টেশনে প্রবেশ করল খুনির মতো মসৃণগতিতে। পিন্টু চলে যায় হাওয়ায় দুটো মাত্র শব্দ ভাসিয়ে, ঠিক আছে---এ...

সকাল বারোটা নাগাদ শ্যামল নামল নৈহাটি স্টেশনে। বাদাম ভর্তি প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো ভাঁজ করে রাখল ব্যাগে। ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রেললাইনের উপর দিয়ে চলে এল এক নং প্ল্যাটফর্মে। তারপর গঙ্গার দিকে যে রাস্তা গিয়েছে তার মাঝামাঝি গিয়ে বাঁ-দিকের গলিটায় ঢুকে পড়ল। ছোট-ছোট খুপরি ঘর। তার সামনে ট্যাপকলের সিমেন্টের আধখাওয়া চাতালে স্নান করছে দুজন কম পোশাকের মেয়ে। এখন এদের পসার বসেনি। শ্যামল আর-একটু এগিয়ে যায়। তিন-চারটি সস্তা জিনস-টপ পরা মেয়ে জটলা করছে। শ্যামলকে দেখেই লাইনের মতো করে দাঁড়াল। চোখে ইশারা।
মাত্র দুশো টাকার বিনিময়ে এদের যে কোন একজনকে শ্যামল আজ পেতে পারে।ণ্টাখানেকের জন্য। একটা অবৈধ সুখ লকে ওঠে শ্যামলের বুকে।
চোদ্দো-পনেরো বছরের ফ্রক পরা রোগা কিশোরী একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে কিতকিত খেলছিল। হঠাৎ শ্যামলকে দেখে খেলার কোট ছেড়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাচ্চাটা এসে তার হাত ধরে টানতে থাকে। মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠে, ‘তং মত কর। অব ধান্দে কি টাইম হ্যাঁয়।’’
মন খারাপ হয়ে গেল শ্যামলের। ফিরে আসে স্টেশনে। ঘণ্টাদুয়েক কাজ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসে ঘরে। ভাত চড়ে স্টোভে। দুটো আলু ধুয়ে ছেড়ে দেয় হাড়ির মধ্যে। মায়ের বিছানার পাশে বসে তারপর তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মা ঘুমোচ্ছে। মৃতদেহের মতো। হাড়গিলে চেহারা। কোমরের নীচ থেকে অসাড়। প্রায় দশ বছর ধরে। মাথায় মাত্র কয়েক গাছি চুল। অথচ আগে কী চুলই না ছিল!
ভাতের ফ্যান গেলে দুটো স্টিলের থালায় ভাত বাড়ে। পিঁয়াজ খুঁজে পায় না। শেষে তেল-নুন দিয়েই মাখে আলুসিদ্ধ। একটা থালা মায়ের ঘরে নিয়ে যায়। ডেকে তোলে। তারপর শিশুর মতো ছোট-ছোট গেরাসে খাওয়াতে থাকে। খাওয়া শেষে মুখ মুছিয়ে রাতের ওষুধ খাইয়ে বেড়ার এধারে চলে আসে শ্যামল। গেঞ্জিটা খুলে ফেলে। বড্ড গরম আজ। ইয়ারফোনটা কানে গোঁজে। খালি গায়ে ইয়ারফোনের সাদা তারটা পৈতের মতো মনে হচ্ছে। এভাবে গান কি শূদ্র শ্যামলকে ব্রাহ্মণ করে তুলল!
ফুল ভলিউমে চালিয়ে দেয়‘অ্যায় কাশ কে হম, হোশ মেঁ অব, আনে না পায়ে...’ সামনে স্টিলের গ্লাস ভরতি ওল্ড মংক। শয়তান সাধু হবে আজ! না, সাধু শয়তান!
কিছুক্ষণ পর আবার মায়ের ঘরে ঢোকে শ্যামল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে।

দিন তিনেক পর আবার হাসপাতালে শ্যামল। ডাক্তার উত্তেজিত।
আপনাকে না বারণ করেছিলাম ইয়ারফোনে গান শুনতে!”
স্যার, প্লিজ! কিছুই কি করা যায় না? সবসময় কানে ব্যথা করে। কোনওকিছুই শুনতে পারি না ভালো ভাবে’’
আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম। এখন আর কিছুই করার নেই’’ একটু থেমে ডাক্তার বিরক্ত ভাবে জানতে চান, ‘‘আমি ঠিক বুঝতে পারি না, আপনারা কী পান বলুন তো এরকম দুটো ঠুলি কানের মধ্যে গুঁজে রেখে? গান তো স্পিকারেও শোনা যায়!
স্যার! এটা হয়তো আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। সারাদিন এই শরীরটার উপর কী যে চলে আমিই জানি। যে কাজ করি তাতে আয়ের কোন ঠিকঠিকানা নেই। আজ দুশো তো কাল পঞ্চাশ। তারমধ্যে যদি ঘরে একজন বারো মাসের রোগী থাকে, তাহলে তো কথাই নেই! ওদিকে আমার সাথে সারাটা জীবন কাটাবে বলে একজন অপেক্ষা করে আছে। জানি না তার আশাপূরণ করতে পারব কিনা! রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-ঠাণ্ডায় সারাটা বছর আমার কাটে ট্রেনে ঘুরে ঘুরে। মানুষের অপমান হাত-পা-ভুঁড়ির গুতো খেয়ে খেয়ে কাটে আমার সারাটা দিন। ইয়ারফোন কানে দিলে আমি এই কঠিন জীবনটা ভুলে থাকতে পারি  স্যার! একটা অন্য আনন্দের জগত সেখানে। গানের বাজনা-সুর-আবেগ আমাকে সব কষ্টের অন্যপারে নিয়ে যায়। মনে হয় এটা হয়তো কোনও সাধনার জগত। দেহ থেকে যেন মনের বিচ্ছেদ তৈরি হয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও। ইচ্ছা করে সব সময় এটা কানে গুঁজে রাখি! এই জীবনে আমি একে ছাড়া বাঁচব না। প্লিজ স্যার, আমার কান ভালো করে দিন। যত টাকা লাগে আমি ধারকর্জ করে জোগা করার চেষ্টা করব।’’
ডাক্তাররা কখন আবেগে ভাসেন না। কিন্তু এই প্রথম শ্যামলের কথা মন দিয়ে শুনলেন মনে হল। একটু যেন নরম দেখাচ্ছে তাকে। শ্যামলের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বললেন, বাড়ি যান এখন। আগামী বুধবার আসুন। দেখি কী করা যায়!

দিন সাতেক পর দুপুরবেলা শ্যামলকে দেখা যায় প্রায় জনমানবহীন ধু-ধু জগদ্দল স্টেশনে। সিমেন্টের চেয়ারে বসে আছে। পাশে নাইলনের ব্যাগ ভরতি বাদামের প্লাস্টিক। যথারীতি কানে ইয়ারফোন। কিন্তু বাঁ-কানে। এবং একটাই। জামার বুক পকেটে একটা মেশিন।

4 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. গল্পটির প্রশংসা না করে পারলাম না।এই নিয়ে ১০ বার পড়লাম, এমনকি ডাউনলোড করে রেখেছি পিডিএফ,আকারে। আমার পড়া শেষ্ট গল্প।গল্পটির বিশেষত্ব হল এই যে -"তার কোনো বিশেষত্ব নেই,কিন্তু গল্পটির অনুভূতি অসাধারন স্থিরতায় আবৃত,যা মানুষকে মানুষের মধ্যে টেনে আনে।
    অসাধারণ, কিছু বলার ভাষা নেই।।Just owsam....

    ReplyDelete