ছবি- প্রদোষ পাল |
মহালয়ার
ভোর। রেডিয়োতে মহিষাসুরমর্দিনী শেষ লগ্নে। হাবুলকে তার মা, ‘ওঠ বাবা।
মহালয়া শুনবি না? শেষ হয়ে গেল।’
ঘুম জড়ানো
চোখে হাবুল,
‘বাবার কাছে ক্যাসেটে শুনে নেব।’
শেষমেশ অবশ্য হাবুল উঠতে বাধ্য হল মায়ের তাড়ায়। ‘রেডিয়োটা চালিয়ে দাও, আমি বাথরুম থেকে শুনব।’
পরে হাবুল ছাদে গিয়ে দেখল ছোটকা, মানে তার ছোটকাকা বীরু, ব্যায়াম করছে ছাদে। ছোটকা বরাবরই হাবুলকে তার ব্যায়ামের দোসর হতে বলে, শারীরিক ক্ষমতাটা বাড়িয়ে রাখা ভালো। কখন কোন বিপদে কাজে লাগে! কিন্তু হাবুল আজ করব কাল করব করে প্রায় ফাঁকি দেয়।
শেষমেশ অবশ্য হাবুল উঠতে বাধ্য হল মায়ের তাড়ায়। ‘রেডিয়োটা চালিয়ে দাও, আমি বাথরুম থেকে শুনব।’
পরে হাবুল ছাদে গিয়ে দেখল ছোটকা, মানে তার ছোটকাকা বীরু, ব্যায়াম করছে ছাদে। ছোটকা বরাবরই হাবুলকে তার ব্যায়ামের দোসর হতে বলে, শারীরিক ক্ষমতাটা বাড়িয়ে রাখা ভালো। কখন কোন বিপদে কাজে লাগে! কিন্তু হাবুল আজ করব কাল করব করে প্রায় ফাঁকি দেয়।
এদিকে
হাবুলের বাবা, মানে বীরুর বড়দা শহরে যাওয়ার জন্য তৈরি।
পুজোর আর কয়েকটা দিন বাকি। মহালয়ার ছুটির দিনে প্রতিমার যাবতীয় কেনাকাটা সেরে
ফেলতে চায়। অগত্যা বীরু ব্যায়াম থামিয়ে দাদার সঙ্গে শহরে গেল প্রতিমার কেনাকাটা
করতে। সে একটু ভুলো মনের। আগের বছর চাঁদমালা, কলাপাতা
আনতে ভুলেছিল। এবার যাওয়ার আগে হাবুল ভালো করে মনে করিয়ে দিল।
ছোটকা
বেরিয়ে যাওয়ার পর হাবুল কী আর করবে, সকালে এসে পড়া ঢাকিদের ঢাক অপটু হাতে
বাজাচ্ছিল। সেই সময় হঠাৎ বাড়ির পোষা কুকুর জিমি ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠল। তার মানে
সদরের বন্ধ দরজার ওদিকে কেউ এসেছে। হাবুল দরজা খুলে দেখল কোঁকড়া চুলের সুন্দর
দেখতে ধোপদুরস্ত পোশাকে বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক। হাবুলের দাদুর নাম করে বলল, ‘রতনলাল
বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই গৃহে বসবাস করেন? আমি তাহার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’
হাবুল জানাল, ‘দাদু পুজো করছেন।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে এই স্থানে অপেক্ষা করি?’
হাবুল জানাল, ‘দাদু পুজো করছেন।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে এই স্থানে অপেক্ষা করি?’
যুবকটির
নাম নাকি গন্ধর্বকুমার। হাবুল ভাবছিল, এমন নাম তো যাত্রায় হয়৷ এমনকি লোকটির কথা
বলার ধরনও যাত্রাসুলভ। এমন শুদ্ধ ভাষায় কেউ কথা বলে নাকি আজকাল? যদিও
প্রথম নজরে তার ভালোই লেগেছে লোকটাকে। হাবুল বলল, ‘না না,
বাইরে নয়,
আপনি ভেতরে এসে বসুন।’
লোকটা যেন
রূপকথার রাজপুত্র। সবই পারে। ঠাকুরদালান সাজানোর জন্য রঙিন কাগজ কেটে সুন্দর-সুন্দর
ডিজাইন কেটে দিল। যে জিমিকে বাইরের কেউ এলে আটকানো যেত না, এত ঘেউঘেউ
করত, সেই
জিমি গন্ধর্বকুমারের হাতের ছোঁয়ায় নিমেষে চুপ মেরে গেল। পুকুরে হাঁসেদের ঝাঁক
লোকটার প্যাঁকপ্যাঁক ডাক শুনে একেবারে পায়ের কাছে হাজির। শুধু কি তাই? হাবুলের
মা কাগজের এক টাকার নোট দিয়ে পাঠিয়েছিল দুটো আধুলি আনতে। লোকটার কাছে ছিল একটা
আধুলি। মুহূর্তে ম্যজিকের মতো হাতের তালুতে আর-একটা আধুলি এনে হাবুলকে দিয়ে দিল! হাবুল
খুব ভালোবেসে ফেলল গন্ধর্বকুমারকে।
ইতিমধ্যে
পুজো উপলক্ষে আমেরিকা থেকে তার মেজোকাকা, কাকিমা ও তাদের ছোট্ট কন্যা তিন্নি এসেও
হাজির। তিন্নিকে হাবুলের অবশ্য ততটা পছন্দ হয় না। সে বড্ড বেশি সব ব্যাপারে প্রশ্ন
করে এবং ইংরেজিতে কথা বলে।
দাদুর পুজো শেষ হতে গন্ধর্বকুমারকে খবর দিল হাবলু। সে-ই বলল, তাকে গন্ধর্বকুমার না বলে যেন গেনুদা বলে ডাকে হাবলু। গেনুদার পরিচয় কীভাবে বলবে সে দাদুর কাছে? গেনুদা বলল, ‘রামদুলালের নাতি’ এসেছে বললেই নাকি দাদু বুঝতে পারবেন।
দাদুর পুজো শেষ হতে গন্ধর্বকুমারকে খবর দিল হাবলু। সে-ই বলল, তাকে গন্ধর্বকুমার না বলে যেন গেনুদা বলে ডাকে হাবলু। গেনুদার পরিচয় কীভাবে বলবে সে দাদুর কাছে? গেনুদা বলল, ‘রামদুলালের নাতি’ এসেছে বললেই নাকি দাদু বুঝতে পারবেন।
তখন দাদু
একে-একে বাড়ির সবাইকে ডেকে ডেকে চরণামৃত দিচ্ছিলেন। হাবুল এসে বলল, ‘রামদুলালের
নাতি’ আসার কথা। দাদু যেন নামটা শুনেই চমকে উঠলেন। শুধু হাবুল নয় বাড়ির অন্য সবাই, এমনকি
আমেরিকা থেকে আসা কাকা-কাকিমা, তাদের মেয়ে তিন্নিও লক্ষ করল, হঠাৎ
দাদুর পরিবর্তন। তৎক্ষণাৎ বাড়ির আদ্যিকালের বিশ্বস্ত চাকর পাঁচুকে পুকুরে জাল
ফেলতে বললেন। বিন্দুমাত্র যেন আতিথেয়তার ত্রুটি না ঘটে ‘রামদুলালের নাতি’র, কড়া
নির্দেশ দিলেন দাদু।
সেদিন
দুপুরে সপরিবারে খেতে বসে হাবুলের দাদু রতন বন্দ্যোপাধ্যায় তিন ছেলে ও দুই বউমার
সামনে সব খুলে বললেন। কে এই রামদুলালের নাতি! কেনই বা
সে এসেছে!
হাবুল সেখানে অবশ্য ছিল না। মানে বাচ্চাদের থাকতে দেওয়া হবে
না বলে আগেই খাইয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ছোটকার থেকে জেনেছে, তার
দাদু নাকি রামদুলাল নামে একজনের বাড়ির পুরোহিতের কাজ করতেন। সেখানে দশভূজার
মন্দিরের বিগ্রহের নীচে মোহর বোঝাই একটা সিন্দুক আবিষ্কার করেন দাদু। চাইলেই তিনি
মোহরের ব্যাপারটা গোপন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে রামদুলালকে বলে দেন। কিছুদিনের
মধ্যে তাদের বাড়িতে ডাকাত পড়ে। সে সময় রামদুলাল মোহর বোঝাই সিন্দুক পুরোহিত রতনদাদুর
কাছে রেখে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে বলে যান তার নাতি পরে তার কাছ থেকে
সিন্দুকটা নিয়ে যাবে। নাতিকে শনাক্ত করবে তাদের পরিবারের শ্বেত ও লোহিত নামে দুই
লেঠেল। নাতির আঙুলে থাকবে দামি হিরের আংটি। নাতি আসবে মহালয়ার দিন। ত্রিশ
বছর পেরিয়ে গেলে অবশ্য রতন বাড়ুজ্যেকে আর মোহর ফেরত দিতে হবে না। দাদু এও
জানিয়েছেন সিন্দুক থেকে কয়েকটি মোহরের বিনিময়ে তাদের এই বিরাট বাড়িটি কেনা হয়েছিল।
আইনত তাই তাদের বাড়ির মালিকও ‘রামদুলালের নাতি’। তাকে বাড়িটি ছেড়ে দিতে হবে। ‘রামদুলালের নাতি’কে দুপুরে দাদু বেশ কিছুক্ষণ
দরজা বন্ধ করে সব যাচাই করছিলেন। তার হাতের আংটিটা সঠিক কিনা, সেটাও।
এদিকে ওই
গ্রামেরই এক চোর, নাম ষষ্ঠীচরণ, ব্যাটা
পথে রামদুলালের নাতির হাতে হিরের আংটিটা দেখেছে। দেখার পর থেকে তার যেন আর আনন্দ ধরে না। হাতালেই লক্ষ টাকা। ইতিমধ্যে
গুপি স্যাঁকরাকে সঙ্গে নিয়ে হাবুলদের বাড়িও ঘুরে গিয়েছে।
‘রামদুলালের
নাতি’র আঙুলে হিরের আংটি দেখেও গেছে৷ ষষ্ঠীর মতলব হল গুপির বানানো অবিকল ওইরকমের
একটা আংটি ছোঁড়ার আঙুলে পরিয়ে আসলটি নিয়ে কেটে পড়া।
ছবি- প্রদোষ পাল |
সেদিন
রাতে কথামতো দুই লেঠেল শ্বেত ও লোহিতের জন্য দাদু অপেক্ষা করছিলেন। হাবুলের ঘুমনোর
প্রশ্নই ছিল না। এতবড় রহস্যজনক ব্যাপার সে নিজের চোখে দেখবে না, তা
কখনও হয়!
ছোটকা বলে রেখেছে ওরা এলে হাবুল যেন তাকে ডেকে দেয়। রাত
সাড়ে বারোটা নাগাদ লাঠি হাতে প্রকাণ্ড লম্বা ও স্বাস্থ্যবান একটি লোক এসে দাদুর
কাছে গেল। পরনে পেঁচানো সাদা ধুতি, মাথায় সাদা পাগড়ি। দাদু ও পাঁচুদা দুজনেই ছিল ঘরে। দুজনেই অবাক হল!
দাদু বললেন, ‘তুমি একা, লোহিত কোথায়?’
শ্বেত উত্তর দিল, ‘আসেনি।’
‘শর্ত ছিল দুজনে মিলে শনাক্ত করবে।’
‘লোহিত আর কোনওদিন আসবে না। সে মারা গ্যাছে।’
পাঁচু বলল, ‘তার প্রমাণ?’
শ্বেত একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল দাদুর দিকে। দাদু কাগজের লেখা ভালো করে পড়ে বললেন, ‘এ কী? এ তো লালচাঁদ বড়াই নামের একজনের ডেথ সার্টিফিকেট!’
‘ওটাই লোহিতের আসল নাম।’
‘তাহলে তো ব্যাপারটা আমাকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হচ্ছে! এই ডেথ সার্টিফিকেট এখন এখানেই থাক। কুমারও এখন এখানেই থাকবে। তুমি দিন সাতেক পরে এসে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’
শ্বেত একটু রাগের স্বরেই বলল, ‘তুমি তো জজমানি করতে রতনদা, ওকালতি ধরলে কবে? চালাকি কোরো না। তুমি ধার্মিক।’
পাঁচু চুপ থাকতে না পেরে, ‘তার বিচার কি তোমার মতো খুনে ডাকাতরা করবে?’
পাঁচুকে থামিয়ে দাদু সিন্দুকটা আনতে বললেন।
দাদুর সন্দেহ না গেলেও বিশ্বাস করে লোকটার হাতে মোহর ভরা সিন্দুকটি তুলে দিলেন। সিন্দুক নিয়ে শ্বেত যখন গন্ধর্বকুমার অর্থাৎ ‘রামদুলালের নাতি’র ঘরে এল হাবুলও জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিল তাদের কথপোকথন। তাদের কথাবার্তা শুনে হাবুলের বুঝতে অসুবিধা হল না আসলে সকালে আসা লোকটা আদৌ রামদুলালের নাতি নয়। নাতির চরিত্রে অভিনয় করেছে কিছু অর্থের বিনিময়ে। সিন্দুকের পুরো মোহর আত্মসাৎ করতে চায় ওই পাগড়ি বাঁধা লেঠেলটা।
এদিকে অন্ধকারে ষষ্ঠী চোর সেই ঘরে লুকিয়ে ছিল ‘রামদুলালের নাতি’র আঙুল থেকে হিরের আংটিটা হাতানোর জন্য।
রামদুলালের নাতি লোকটার কাছে জানতে চাইল, ‘লোহিত বাবু কোথায়?’
শ্বেত নামের লোকটি বলল, ‘তার মাথায় ডান্ডা মেরে এসেছি।’
লুকিয়ে থাকা ষষ্ঠীচরণ এই কথায় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা হাবুলের গায়ে এসে পড়ল। হাবুল চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তার মুখে ষষ্ঠী হাত দিয়ে চুপ করাল।
হাবুল প্রথমটায় বুঝতে পারেনি কে লোকটা! কারণ ষষ্ঠীর গোঁফ ছিল না, এর আবার গোঁফ রয়েছে। হাবুলের সন্দেহজনক তাকানো দেখে সে বলে উঠল, ‘শোনো, আমি তোমাদের বাড়ি চুরি করতে আসিনি, ওই লোকটার আংটি নিয়ে কেটে পড়ব বলে এসেছিলাম।’
হাবুল চাপা গলায় বলল, ‘গোঁফ লাগিয়েছ কেন? ভেবেছ চেনা যাচ্ছে না!’
ষষ্ঠী বলল, ‘বাড়ির বড়দের খবর দাও। শুনলেই তো সব নিজের কানে!’
হাবুল ছুটল ছোটকাকে ডাকতে।
এদিকে শ্বেত তখন সিন্দুক মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। বুক চিতিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল পাঁচুদা। বহুদিনের পুরনো চাকর পাঁচুদার চেহারাও কম নয়। লাঠি উঁচিয়ে পথ আটকে দাঁড়ল। শুরু হল দুজনের লাঠির লড়াই। একবার এ ওকে তো আর-একবার ও একে ধারশায়ী করে৷ শেষমেশ অবশ্য পাঁচুদার মাথায় লাঠির ঘা পড়ে ও রক্তারক্তি হয়ে অজ্ঞান হয়ে উঠোনে পড়ে যায়। লেঠেল লোকটা সিন্দুক নিয়ে যেই পালাতে যাবে অমনি সিঁড়ির আড়াল থেকে সজোরে কেউ তাকে এক লাথি কষাল। লোকটা পড়ে গেল। আড়াল থেকে ছোটকাকে বেরিয়ে আসতে দেখল হাবুল। সেই মেরেছে লাথি। বীর বীরুকাকা। ব্যায়াম করা ছোটকার শরীরে কত শক্তি হাবুল সেদিন টের পেল। প্রকাণ্ড লোকটাও পেরে উঠল না ছোটকার সঙ্গে। শেষে ধরাশায়ী হল৷ ছোটকা যখন লোকটাকে বাঁধার জন্য একটা দড়ি খুঁজছে সেই সময় গন্ধর্বকুমার, তথা গেনুদা, তথা ‘রামদুলালের নাতি’ ছুটে এসে তার কাঁধে থাকা সাইড ব্যাগ থেকে বেশ বড়সড় একটা দড়ি ছোটকার দিকে বাড়িয়ে দিল। ছোটকা বিস্ময়ে ‘রামদুলালের নাতি’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর কী কী আছে বলুন তো আপনার ব্যাগে?’
দাদু বললেন, ‘তুমি একা, লোহিত কোথায়?’
শ্বেত উত্তর দিল, ‘আসেনি।’
‘শর্ত ছিল দুজনে মিলে শনাক্ত করবে।’
‘লোহিত আর কোনওদিন আসবে না। সে মারা গ্যাছে।’
পাঁচু বলল, ‘তার প্রমাণ?’
শ্বেত একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল দাদুর দিকে। দাদু কাগজের লেখা ভালো করে পড়ে বললেন, ‘এ কী? এ তো লালচাঁদ বড়াই নামের একজনের ডেথ সার্টিফিকেট!’
‘ওটাই লোহিতের আসল নাম।’
‘তাহলে তো ব্যাপারটা আমাকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হচ্ছে! এই ডেথ সার্টিফিকেট এখন এখানেই থাক। কুমারও এখন এখানেই থাকবে। তুমি দিন সাতেক পরে এসে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’
শ্বেত একটু রাগের স্বরেই বলল, ‘তুমি তো জজমানি করতে রতনদা, ওকালতি ধরলে কবে? চালাকি কোরো না। তুমি ধার্মিক।’
পাঁচু চুপ থাকতে না পেরে, ‘তার বিচার কি তোমার মতো খুনে ডাকাতরা করবে?’
পাঁচুকে থামিয়ে দাদু সিন্দুকটা আনতে বললেন।
দাদুর সন্দেহ না গেলেও বিশ্বাস করে লোকটার হাতে মোহর ভরা সিন্দুকটি তুলে দিলেন। সিন্দুক নিয়ে শ্বেত যখন গন্ধর্বকুমার অর্থাৎ ‘রামদুলালের নাতি’র ঘরে এল হাবুলও জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিল তাদের কথপোকথন। তাদের কথাবার্তা শুনে হাবুলের বুঝতে অসুবিধা হল না আসলে সকালে আসা লোকটা আদৌ রামদুলালের নাতি নয়। নাতির চরিত্রে অভিনয় করেছে কিছু অর্থের বিনিময়ে। সিন্দুকের পুরো মোহর আত্মসাৎ করতে চায় ওই পাগড়ি বাঁধা লেঠেলটা।
এদিকে অন্ধকারে ষষ্ঠী চোর সেই ঘরে লুকিয়ে ছিল ‘রামদুলালের নাতি’র আঙুল থেকে হিরের আংটিটা হাতানোর জন্য।
রামদুলালের নাতি লোকটার কাছে জানতে চাইল, ‘লোহিত বাবু কোথায়?’
শ্বেত নামের লোকটি বলল, ‘তার মাথায় ডান্ডা মেরে এসেছি।’
লুকিয়ে থাকা ষষ্ঠীচরণ এই কথায় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা হাবুলের গায়ে এসে পড়ল। হাবুল চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তার মুখে ষষ্ঠী হাত দিয়ে চুপ করাল।
হাবুল প্রথমটায় বুঝতে পারেনি কে লোকটা! কারণ ষষ্ঠীর গোঁফ ছিল না, এর আবার গোঁফ রয়েছে। হাবুলের সন্দেহজনক তাকানো দেখে সে বলে উঠল, ‘শোনো, আমি তোমাদের বাড়ি চুরি করতে আসিনি, ওই লোকটার আংটি নিয়ে কেটে পড়ব বলে এসেছিলাম।’
হাবুল চাপা গলায় বলল, ‘গোঁফ লাগিয়েছ কেন? ভেবেছ চেনা যাচ্ছে না!’
ষষ্ঠী বলল, ‘বাড়ির বড়দের খবর দাও। শুনলেই তো সব নিজের কানে!’
হাবুল ছুটল ছোটকাকে ডাকতে।
এদিকে শ্বেত তখন সিন্দুক মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। বুক চিতিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল পাঁচুদা। বহুদিনের পুরনো চাকর পাঁচুদার চেহারাও কম নয়। লাঠি উঁচিয়ে পথ আটকে দাঁড়ল। শুরু হল দুজনের লাঠির লড়াই। একবার এ ওকে তো আর-একবার ও একে ধারশায়ী করে৷ শেষমেশ অবশ্য পাঁচুদার মাথায় লাঠির ঘা পড়ে ও রক্তারক্তি হয়ে অজ্ঞান হয়ে উঠোনে পড়ে যায়। লেঠেল লোকটা সিন্দুক নিয়ে যেই পালাতে যাবে অমনি সিঁড়ির আড়াল থেকে সজোরে কেউ তাকে এক লাথি কষাল। লোকটা পড়ে গেল। আড়াল থেকে ছোটকাকে বেরিয়ে আসতে দেখল হাবুল। সেই মেরেছে লাথি। বীর বীরুকাকা। ব্যায়াম করা ছোটকার শরীরে কত শক্তি হাবুল সেদিন টের পেল। প্রকাণ্ড লোকটাও পেরে উঠল না ছোটকার সঙ্গে। শেষে ধরাশায়ী হল৷ ছোটকা যখন লোকটাকে বাঁধার জন্য একটা দড়ি খুঁজছে সেই সময় গন্ধর্বকুমার, তথা গেনুদা, তথা ‘রামদুলালের নাতি’ ছুটে এসে তার কাঁধে থাকা সাইড ব্যাগ থেকে বেশ বড়সড় একটা দড়ি ছোটকার দিকে বাড়িয়ে দিল। ছোটকা বিস্ময়ে ‘রামদুলালের নাতি’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর কী কী আছে বলুন তো আপনার ব্যাগে?’
থামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে লোকটাকে বেঁধে ফেলল ছোটকা। হইহল্লাতে
বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে গেছে তখন। সবাই নীচে নেমে এসেছে। হাবুলের দাদুও।
সবাই অবাক হল ‘রামদুলালের নাতি’কে দেখে। তার মধ্যে এতটুকু অপরাধবোধ নেই। তাকে যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই কাজে লাগানো হয়েছিল, গড়গড় করে সে সব বলে গেল।
সবাই অবাক হল ‘রামদুলালের নাতি’কে দেখে। তার মধ্যে এতটুকু অপরাধবোধ নেই। তাকে যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই কাজে লাগানো হয়েছিল, গড়গড় করে সে সব বলে গেল।
‘আমার
অভিনয় আপনাদের ভালো লাগেনি?’
হাবলুর মেজোকাকা বলল, ‘ভালো, তবে শুধুশুধু এতবড় রিস্ক নিতে গেলেন কেন?’
রামদুলালের নাতি লেঠেলকে দেখিয়ে বলল, ‘ও বলেছিল, রাজপুত্রর পার্ট করে ওর সম্পত্তি উদ্ধার করে দিলে বোম্বে যাওয়ার ট্রেনভাড়া আর কয়েকদিনের থাকাখাওয়ার খরচ দেবে।’
সবাই অবাক হল। দাদু বলল, ‘তাহলে সামান্য এই ক’টা টাকার জন্য তুমি আমাদের এতবড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিলে?’
‘ও আমাকে সব বলেছিল জানেন! দশ কাঠা জমির ওপর বাড়ি, নাটমন্দির, সিন্দুক ভরা মোহর, সব। শুধু একটা কথা বলেনি যে এ বাড়িতে হাবুল আর তিন্নি আছে। অবশ্য এই সুযোগে একটা লাভ হয়ে গেল। হাবুল আর তিন্নির সঙ্গে আলাপটা হয়ে গেল!’
মেজোকাকা আবার বলল, ‘আপনার ওই আংটির দাম কত জানেন?’
‘সঠিক জানি না তবে দামি নিশ্চয়ই।’
‘এ দিয়েই তো আপনি বোম্বে যেতে পারতেন! তাহলে এতটা ঝামেলায় পড়তে হত না।’
'শো চলাকালীন কোনো অভিনেতা তার মেক-আপের জিনিস বিক্রি করে না। সে যতই দামি হোক। এটা আমার রাজপুত্রের মেক-আপ। ওর সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল খেলা শেষে ওর আংটি আমি ফিরিয়ে দেব।’
দাদু বলল, ‘প্রয়োজন নেই। আংটি তোমার কাছেই রেখে দাও। আমি বলছি।’
‘আমি লটারি চাইনি। উপার্জন করতে চেয়েছিলাম। আমার অভিনয়ের পারিশ্রমিক।’
হাবলুর মেজোকাকা বলল, ‘ভালো, তবে শুধুশুধু এতবড় রিস্ক নিতে গেলেন কেন?’
রামদুলালের নাতি লেঠেলকে দেখিয়ে বলল, ‘ও বলেছিল, রাজপুত্রর পার্ট করে ওর সম্পত্তি উদ্ধার করে দিলে বোম্বে যাওয়ার ট্রেনভাড়া আর কয়েকদিনের থাকাখাওয়ার খরচ দেবে।’
সবাই অবাক হল। দাদু বলল, ‘তাহলে সামান্য এই ক’টা টাকার জন্য তুমি আমাদের এতবড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিলে?’
‘ও আমাকে সব বলেছিল জানেন! দশ কাঠা জমির ওপর বাড়ি, নাটমন্দির, সিন্দুক ভরা মোহর, সব। শুধু একটা কথা বলেনি যে এ বাড়িতে হাবুল আর তিন্নি আছে। অবশ্য এই সুযোগে একটা লাভ হয়ে গেল। হাবুল আর তিন্নির সঙ্গে আলাপটা হয়ে গেল!’
মেজোকাকা আবার বলল, ‘আপনার ওই আংটির দাম কত জানেন?’
‘সঠিক জানি না তবে দামি নিশ্চয়ই।’
‘এ দিয়েই তো আপনি বোম্বে যেতে পারতেন! তাহলে এতটা ঝামেলায় পড়তে হত না।’
'শো চলাকালীন কোনো অভিনেতা তার মেক-আপের জিনিস বিক্রি করে না। সে যতই দামি হোক। এটা আমার রাজপুত্রের মেক-আপ। ওর সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল খেলা শেষে ওর আংটি আমি ফিরিয়ে দেব।’
দাদু বলল, ‘প্রয়োজন নেই। আংটি তোমার কাছেই রেখে দাও। আমি বলছি।’
‘আমি লটারি চাইনি। উপার্জন করতে চেয়েছিলাম। আমার অভিনয়ের পারিশ্রমিক।’
গেনুদা, তথা
‘রামদুলালের নাতি’র সততা দেখে সবাই খুব খুশি হল৷ সবচেয়ে খুশি হল হাবুল। তার চোখে
শুধু বিস্ময়! মানুষটা এত ভালো!
গেনুদা পুরো ঘটনাটা খুলে বলল সবার কাছে, ‘আসলে রামদুলাল আর তার নাতি কেউ আর আজ জীবিত নেই। বাড়ি থেকে পালিয়ে তারা এক গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করে। সেখানে বিষাক্ত এক কীটের দংশনে তারা আক্রান্ত হয়। এবং কয়েকদিন পরেই প্রাণত্যাগ করে। মৃত্যুর পূর্বে শ্বেত আর লোহিত তাদের সেবা করেছিল। তাই মারা যাওয়ার আগে এই হীরক অঙ্গুরীয় রামদুলাল তাদের দিয়ে যায়। সেদিন থেকে তারা সমানে সন্ধান করেছে এমন একজনের যে রামদুলালের নাতির ভূমিকায় অভিনয় করতে পারবে। অবশেষে তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি একজন অভিনেতা। শৈশব থেকে স্বপ্ন ছিল বোম্বে গিয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা হওয়ার।’
মেজোকাকা বলল, ‘আপনার নাম কী?’
‘দিলীপকুমার বিশ্বাস।’
মেজোকাকা গেনুদাকে ডাকল, ‘আসুন আমার সঙ্গে। আপনার বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
গেনু তথা ‘রামদুলালের নাতি’র বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
গেনুদা পুরো ঘটনাটা খুলে বলল সবার কাছে, ‘আসলে রামদুলাল আর তার নাতি কেউ আর আজ জীবিত নেই। বাড়ি থেকে পালিয়ে তারা এক গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করে। সেখানে বিষাক্ত এক কীটের দংশনে তারা আক্রান্ত হয়। এবং কয়েকদিন পরেই প্রাণত্যাগ করে। মৃত্যুর পূর্বে শ্বেত আর লোহিত তাদের সেবা করেছিল। তাই মারা যাওয়ার আগে এই হীরক অঙ্গুরীয় রামদুলাল তাদের দিয়ে যায়। সেদিন থেকে তারা সমানে সন্ধান করেছে এমন একজনের যে রামদুলালের নাতির ভূমিকায় অভিনয় করতে পারবে। অবশেষে তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি একজন অভিনেতা। শৈশব থেকে স্বপ্ন ছিল বোম্বে গিয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা হওয়ার।’
মেজোকাকা বলল, ‘আপনার নাম কী?’
‘দিলীপকুমার বিশ্বাস।’
মেজোকাকা গেনুদাকে ডাকল, ‘আসুন আমার সঙ্গে। আপনার বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
গেনু তথা ‘রামদুলালের নাতি’র বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
পরের দিন
সকালে গেনুদার যাওয়ার সময় হাবুলের খুব মনখারাপ। মাত্র একটা দিনে সে গেনুদাকে এতটাই
ভালোবেসে ফেলেছে তাকে ছাড়ার কথা যেন ভাবতেই পারছিল না।
‘গেনুদা তুমি আর এখানে আসবে না?’
‘আসব। মহালয়ার দিন’
‘ঠিক তো?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘ভুলবে না?’
‘না। তুমি যাতে আমায় না ভোলো সে জন্য এটা তোমায় দিয়ে গেলাম।’
আংটি হাতে নিয়ে হাবুল বিস্মিত!
গেনুদা বলল, ‘ওটা ছোট নয়, আসল কমল হিরে।’
‘গেনুদা তুমি আর এখানে আসবে না?’
‘আসব। মহালয়ার দিন’
‘ঠিক তো?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘ভুলবে না?’
‘না। তুমি যাতে আমায় না ভোলো সে জন্য এটা তোমায় দিয়ে গেলাম।’
আংটি হাতে নিয়ে হাবুল বিস্মিত!
গেনুদা বলল, ‘ওটা ছোট নয়, আসল কমল হিরে।’
আস্তে
আস্তে গেনুদা, মানে ‘রামদুলালের নাতি’ মাঠের পথে
মিলিয়ে গেল।
ছবি- প্রদোষ পাল |
এতক্ষণ
বর্ণনা করলাম প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালিত ১৯৯২ সালের ছবি ‘হীরের আংটি’ নিয়ে।
বাংলা চলচ্চিত্রজগতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পর শক্তিশালী পরিচালকদের মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা বলতেই হবে। দুর্ভাগ্য, অসময়ে তিনি পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। ঋতুপর্ণ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও ‘হীরের আংটি’ ছবিটি শিশু-কিশোরদের জন্য৷ বাংলা চলচ্চিত্রজগতে শিশু ও কিশোরদের জন্য ছবি নির্মাণ প্রায় উঠে গিয়েছে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফেলুদা সিরিজ বাদ দিলে হাতেগোনা দু-একটি সার্থক চলচ্চিত্র দেখা যায়। যদিও গভীর ভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রথম সারির প্রখ্যাত পরিচালকদের পরিচালিত চলচ্চিত্র-তালিকায় একটি বা দুটির বেশি শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত ছবি নেই। ঋতুপর্ণও একটির বেশি শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি নির্মাণ করেননি। বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আরও এমন ছবি করতেন কিনা জানি না, তবে ‘হীরের আংটি’ যে মানের ছবি, আপশোশ হয় এমন আরও শিশু-কিশোরদের ছবি থেকে বাংলা চলচ্চিত্রজগত হয়তো বঞ্চিত হয়েছে।
মূল কাহিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হলেও কাহিনির নির্যাস অক্ষুণ্ন রেখে চমৎকার নিজের মতো চিত্রনাট্য বানিয়ে নিয়েছেন। চরিত্রগুলোর নাম ও সুরটুকু ছাড়া প্রায় কোনো মিলই নেই মূল উপন্যাসের সঙ্গে। এত সুন্দর টানটান চিত্রনাট্য অবাক করার মতো। ঋতুপর্ণর বহু সিরিয়াস ছবিতে যা পাইনি ‘হীরের আংটি’তে তা পেয়েছি। ওঁর অন্যান্য ছবিতে যত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী দেখেছি আমরা। বোধকরি বাংলা চলচ্চিত্রজগতে ঋতুপর্ণই তারকামণ্ডিত চলচ্চিত্রের সূচনা করেন। সত্যজিৎ তো বটেই অন্যান্য পরিচালকরাও চেষ্টা করতেন কম বাজেটে তারকাহীন ছবি পরিচালনা করতে। স্বাভাবিক ভাবে তার জন্য বাড়তি মেহনত তাঁদের করতে হত। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এমন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন যাঁদের সঙ্গে অভিনয় জগতের কোনো সম্পর্কই ছিল না প্রায়। শুধু তাই নয় সত্যজিতের একটি বা দুটি ছবি ছাড়া পরবর্তী জীবনে তাঁরা আর কোনো ছবিতে অভিনয়ই করেননি। স্বভাবতই এইসব আনকোরা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে চলচ্চিত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে তাঁকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হত। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এমনটা না দেখা গেলেও এঁরা কেউই বড় মাপের তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে খুব একটা ছবিতে কাজে লাগাননি। তার প্রধান ও প্রথম কারণ বাজেট। অর্থাৎ এসব ছবি বাণিজ্যিক ভাবে ততটা সফল হয়নি বা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ফলে কম বাজেটে ছবি করতেই হত। দ্বিতীয়ত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এমন একটা ইমেজ গড়ে ওঠে, সিনেমা জগতের দর্শকরা তাদের প্রিয় তারকাদের ইমেজের বাইরের চরিত্রে দেখতে পছন্দ করতেন না বা করেন না। সত্যজিৎ রায়ও সে যুগের অন্যতম তারকা উত্তমকুমারকে যে দুটি ছবিতে ব্যবহার করেছেন সে ছবি দুটোর মুখ্য চরিত্রে উত্তমই ছিলেন। উত্তমের অনুগত ভক্তদের অপছন্দ হওয়ার প্রশ্ন ছিল না। সুচিত্রা সেনকে নিয়েও সত্যজিৎ যে ছবি করতে চেয়েছিলেন তারও মুখ্য চরিত্রে মিসেস সেনই ছিলেন। যে কারণেই হোক সে ছবি নির্মিত হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ের পরিচালকদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, রাজা সেনরাও তেমন মাপের তারকাদের ছবিতে আমদানি করার কথা ততটা ভাবেননি। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম একটি বা দুটি ছবি ছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে তারকা ছাড়া অভিনয় করানোর কথা ভাবতেই পারতেন না। শুধু বঙ্গতারকা নয় মুম্বাই চলচ্চিত্রজগতের প্রথম সারির নায়ক-নায়িকা সমাবেশে চলচ্চিত্র পরিচালনা আমদানি করেছিলেন তিনি। তাতে কতটা সফল তিনি হয়েছিলেন বা হননি সে আলোচনা আলাদা, তবে ‘হীরের আংটি’ ঋতুপর্ণর একমাত্র ছবি যেখানে কোনো তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না। পুরনো দিনের নামকরা অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী জীবনের শেষের দিকে এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। আর যাইহোক তখন ওঁকে তারকা অভিনেতা বলা যায় না। আর দ্বিতীয় কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না যাঁদের তারকা বলা যায়৷ আশ্চর্য যেটা, তারকাহীন অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়েই ‘হীরের আংটি’ কিন্তু বাজিমাত করলেন। টানটান চিত্রনাট্য যেমন এ ছবির অন্যতম দিক, অভিনয়ও এ ছবির আর-একটি সফল দিক। এত নিখুঁত চরিত্র নির্বাচন ঋতুপর্ণর অন্যান্য ছবিতে ততটা আমি দেখিনি। এককথায় খুবই উচ্চমানের শিশুচলচ্চিত্র ‘হীরের আংটি’কে বলতেই হবে৷
বাংলা চলচ্চিত্রজগতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পর শক্তিশালী পরিচালকদের মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা বলতেই হবে। দুর্ভাগ্য, অসময়ে তিনি পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। ঋতুপর্ণ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও ‘হীরের আংটি’ ছবিটি শিশু-কিশোরদের জন্য৷ বাংলা চলচ্চিত্রজগতে শিশু ও কিশোরদের জন্য ছবি নির্মাণ প্রায় উঠে গিয়েছে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফেলুদা সিরিজ বাদ দিলে হাতেগোনা দু-একটি সার্থক চলচ্চিত্র দেখা যায়। যদিও গভীর ভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রথম সারির প্রখ্যাত পরিচালকদের পরিচালিত চলচ্চিত্র-তালিকায় একটি বা দুটির বেশি শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত ছবি নেই। ঋতুপর্ণও একটির বেশি শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি নির্মাণ করেননি। বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আরও এমন ছবি করতেন কিনা জানি না, তবে ‘হীরের আংটি’ যে মানের ছবি, আপশোশ হয় এমন আরও শিশু-কিশোরদের ছবি থেকে বাংলা চলচ্চিত্রজগত হয়তো বঞ্চিত হয়েছে।
মূল কাহিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হলেও কাহিনির নির্যাস অক্ষুণ্ন রেখে চমৎকার নিজের মতো চিত্রনাট্য বানিয়ে নিয়েছেন। চরিত্রগুলোর নাম ও সুরটুকু ছাড়া প্রায় কোনো মিলই নেই মূল উপন্যাসের সঙ্গে। এত সুন্দর টানটান চিত্রনাট্য অবাক করার মতো। ঋতুপর্ণর বহু সিরিয়াস ছবিতে যা পাইনি ‘হীরের আংটি’তে তা পেয়েছি। ওঁর অন্যান্য ছবিতে যত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী দেখেছি আমরা। বোধকরি বাংলা চলচ্চিত্রজগতে ঋতুপর্ণই তারকামণ্ডিত চলচ্চিত্রের সূচনা করেন। সত্যজিৎ তো বটেই অন্যান্য পরিচালকরাও চেষ্টা করতেন কম বাজেটে তারকাহীন ছবি পরিচালনা করতে। স্বাভাবিক ভাবে তার জন্য বাড়তি মেহনত তাঁদের করতে হত। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এমন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন যাঁদের সঙ্গে অভিনয় জগতের কোনো সম্পর্কই ছিল না প্রায়। শুধু তাই নয় সত্যজিতের একটি বা দুটি ছবি ছাড়া পরবর্তী জীবনে তাঁরা আর কোনো ছবিতে অভিনয়ই করেননি। স্বভাবতই এইসব আনকোরা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে চলচ্চিত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে তাঁকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হত। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এমনটা না দেখা গেলেও এঁরা কেউই বড় মাপের তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে খুব একটা ছবিতে কাজে লাগাননি। তার প্রধান ও প্রথম কারণ বাজেট। অর্থাৎ এসব ছবি বাণিজ্যিক ভাবে ততটা সফল হয়নি বা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ফলে কম বাজেটে ছবি করতেই হত। দ্বিতীয়ত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এমন একটা ইমেজ গড়ে ওঠে, সিনেমা জগতের দর্শকরা তাদের প্রিয় তারকাদের ইমেজের বাইরের চরিত্রে দেখতে পছন্দ করতেন না বা করেন না। সত্যজিৎ রায়ও সে যুগের অন্যতম তারকা উত্তমকুমারকে যে দুটি ছবিতে ব্যবহার করেছেন সে ছবি দুটোর মুখ্য চরিত্রে উত্তমই ছিলেন। উত্তমের অনুগত ভক্তদের অপছন্দ হওয়ার প্রশ্ন ছিল না। সুচিত্রা সেনকে নিয়েও সত্যজিৎ যে ছবি করতে চেয়েছিলেন তারও মুখ্য চরিত্রে মিসেস সেনই ছিলেন। যে কারণেই হোক সে ছবি নির্মিত হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ের পরিচালকদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, রাজা সেনরাও তেমন মাপের তারকাদের ছবিতে আমদানি করার কথা ততটা ভাবেননি। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম একটি বা দুটি ছবি ছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে তারকা ছাড়া অভিনয় করানোর কথা ভাবতেই পারতেন না। শুধু বঙ্গতারকা নয় মুম্বাই চলচ্চিত্রজগতের প্রথম সারির নায়ক-নায়িকা সমাবেশে চলচ্চিত্র পরিচালনা আমদানি করেছিলেন তিনি। তাতে কতটা সফল তিনি হয়েছিলেন বা হননি সে আলোচনা আলাদা, তবে ‘হীরের আংটি’ ঋতুপর্ণর একমাত্র ছবি যেখানে কোনো তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না। পুরনো দিনের নামকরা অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী জীবনের শেষের দিকে এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। আর যাইহোক তখন ওঁকে তারকা অভিনেতা বলা যায় না। আর দ্বিতীয় কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না যাঁদের তারকা বলা যায়৷ আশ্চর্য যেটা, তারকাহীন অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়েই ‘হীরের আংটি’ কিন্তু বাজিমাত করলেন। টানটান চিত্রনাট্য যেমন এ ছবির অন্যতম দিক, অভিনয়ও এ ছবির আর-একটি সফল দিক। এত নিখুঁত চরিত্র নির্বাচন ঋতুপর্ণর অন্যান্য ছবিতে ততটা আমি দেখিনি। এককথায় খুবই উচ্চমানের শিশুচলচ্চিত্র ‘হীরের আংটি’কে বলতেই হবে৷
অবাক লাগে
এই মাপের একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও বোদ্ধা জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভুগে নিজে
শুধু শেষ হয়ে গেলেন না আমার মতে বাংলা চলচ্চিত্রে কিছুটা ক্ষতিও করে গেলেন। টিভি
সিরিয়ালে গয়না পরা ঝকঝকে পোশাক বা বেনারসী পরা চরিত্র আমরা বহুদিন থেকে দেখতে
অভ্যস্ত। বলা যেতে পারে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ, মহাভারতের
হাত ধরে। চরিত্র যত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হোক অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে হতে হবে কচি-কচি।
ক্যালেন্ডারের কার্বন কপি। পাবলিক সেসময় কতটা চেটেপুটে খেয়েছে আমরা জানি।
বর্তমানের সিরিয়ালগুলোর দিকে একঝলক চোখ রাখলেই বুঝতে পারা যায় কচিকাঁচাদের কত
রমরমা। ষোলো-সতেরো বছর বা তারও কম বয়সের মেয়েরা মাথায় এক পোঁচ সাদা রং লাগিয়ে ষাট-সত্তর
বছর বয়সের বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করছে। আক্ষরিকই এরা কেউ কেউ একাদশ, দ্বাদশ
শ্রেণির ছাত্রী। আসল কথা কচি সুন্দর মুখ হতে হবে।
কেন যেন
আমার বারবার মনে হয় ঋতুপর্ণর মধ্যেও এই বাহ্যিক সৌন্দর্যের মোহ ছিল। আমি তাঁর খুব
কম ছবির কোনো চরিত্রে অসুন্দর, খেঁকুড়ে চরিত্রাভিনেতা দেখেছি। যেমন দেখিনি
চরিত্রনির্ভর স্বাভাবিক আটপৌরে পোশাক। এত ঝকঝকে চকচকে পোশাকের চরিত্র সিরিয়ালে
আমরা দেখতে অভ্যস্ত কিন্তু কোনো সিরিয়াস চলচ্চিত্রে বড় বেমানান লাগে। একদম প্রথম
দিকের কিছু ছবিতে তাও দেখা গেছে, কিন্তু পরের দিকে আমার অন্তত বড্ড চোখে
লেগেছে। অসাধারণ টানটান চিত্রনাট্য, সংগীত ও
ক্যামেরার দক্ষতায় এসব দিকে অনেক দর্শকের চোখ হয়তো পড়েনি, কিন্তু
একটু ভালো করে খেয়াল করলে ঠিকই চোখে পড়বে। ‘হীরের আংটি’ ছবিতে চোরের ভূমিকায় সুনীল
মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন শুধু এ জন্যই ওঁকে কুর্নিশ জানাব।
লজ্জা হয় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অসামান্য অভিনেতাকে
তেমনভাবে কেউ কাজেই লাগাননি। অভাব অনটনে অসময়ে চলে যেতে
হল। এমন সাধারণ দেখতে অসাধারণ
অভিনেতা-অভিনেত্রীর তালিকা কম নয় যাঁরা অসামান্য অভিনয়দক্ষতা সত্ত্বেও বাংলা ফিল্ম
ইন্ড্রাস্টির কোনো বদান্যতা না পেয়ে হারিয়ে গেছেন। এখানে শুধু সৌন্দর্যের রমরমা। ওমপুরি মারা যাওয়ার পর বহু কষ্টে
মজা করে লিখেছিলুম, ওমপুরির মতো অভিনেতা এই বাংলায় জন্মালে হয়তো
সুনীল মুখোপাধ্যায়ের মতো না খেয়ে মরতেন।
প্রথমদিকে ঋতুপর্ণ যাই করুন পরেরদিকে উনিও তার দায় এড়াতে পারেন না।
প্রথমদিকে ঋতুপর্ণ যাই করুন পরেরদিকে উনিও তার দায় এড়াতে পারেন না।
বেশ্ 👍
ReplyDeleteOSHADHARON
ReplyDeleteDaarun....aweshadharon
ReplyDelete