বাক্‌ ১৩৯ ।। ডাবলিন শহরের বাসিন্দারা ।। আবেশ কুমার দাস



ডাবলিন শহরের বাসিন্দারা

দ্যাখ বাবু। তোকে বলছিলাম না সেদিনওই যে রাজা মিয়াঁর বাড়ি...
         এই বাড়িটা! আচ্ছা, দেখেছি তো। এই বাড়িটার কথাই বলছিলে!
         আর হবে না এমন বাড়ি। দ্যাখ দোতলার খিলেনগুলো। নামাজ পড়া হত ওই বারান্দায়...
         তোমার কোন মাসি থাকত বলছিলে না...
         মাসি নয়, পিসি। কত আসতাম ছোটবেলায়। ভেতরে না ঢুকলে ভাবতেও পারবি না যে কী সুন্দর বাড়িটা!
মিত্রপাড়া ব্রাঞ্চ রোড পার হচ্ছিল টোটোটা।
         বিকেল না ফুরোতেই আলো জ্বলে উঠেছে একতলার একটা ঘরে। সদরে ঝুলছে সাইনবোর্ড। স্পার্ক গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড গ্ল্যামার বানানটা অপরিচিত। আমেরিকান বানান কিনা কে জানে। নামটা পড়তে পড়তেই জুতোর পাটি খুলে ঠেকনোর কায়দায় ডান পা-টা সামনের সিটে তুলে দেয় অপূর্ব। একগাদা বাক্স আর প্যাকেট ডাঁই হয়ে আছে ফালি সিটটায়। অনেক কেনাকাটা হয়েছে আজ। আর বসে থাকলে হবে না দেখতে দেখতেই এসে পড়বে সাতাশে মাঘ
         সারা দুপুর টইটই করে গোটা অরবিন্দ রোডটাকে চষে ফেলার পর ক্যানিংহাম রোডের মুখ থেকে টোটোটা পাওয়া গেল ভাগ্যিস। নইলে পায়ের যা পরিস্থিতি মা-র। দ্বিতীয়বার রেলের ওভারব্রিজ ভাঙা সহজ হত না। ওদিকে ট্র্যাফিকের নতুন নিয়মে বেশি যানজটের রাস্তাগুলোয় সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা অবধি ঢোকার পারমিট নেই টোটোর। ক্যানিংহাম রোড থেকে জানমহম্মদ ঘাট রোড হয়ে মিত্রপাড়া ব্রাঞ্চ রোডের গলিতে ঢুকে পড়ল তিন চাকার দুবলাপাতলা গাড়িটা।
         নামটা অদ্ভুত। রাজা মিয়াঁ। মুসলমানের নাম রাজা হয়!
         অন্য কোনও নাম ছিল হয়তো। কিন্তু রাজা মিয়াঁই বলত লোকে।
         দেখেছ লোকটাকে ছোটবেলায়?
         নারাজা মিয়াঁকে চোখে দেখিনি আমরা। আমাদের জন্মের আগেই বাড়ি বেচে দিয়ে এখান থেকে চলে গিয়েছিল লোকটাকিন্তু ওই রাজা মিয়াঁর বাড়ি বলেই চিনত সবাই। ভাবতে পারছিস, আমাদের জন্মেরও কত যুগ আগের বাড়ি...
         কেন? চলে গেল কেন?
         তখন পার্টিশনের জমানা। প্রাণের ভয় তো থাকে সবারই। আধাকড়িতেই ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলজলের দরেই বলতে গেলে তাই পেয়ে গিয়েছিল পিসেমশাই...
         কোন পিসি?
         তুই দেখিসনি তাকে। নিজের পিসিও নয় ঠিক আমাদের। সেই কৃষ্ণনগরের ছোটদিদুকে মনে আছে তোর? তারই নিজের ভাসুর কিনেছিল এই বাড়িতা পিসির জা মানে পিসিই হল। খুব ভালবাসত আমাদের। তখন এইটুকু-টুকু সব আমরাপ্রায়দিন চলে আসতাম পিসির বাড়ি...
         সোনামাসি, মাসিমণিরাও আসত?
         তিন বোনেই আসতামভেতরের উঠোনে খেলেছি কত...
         উঠোনও আছে ভেতরে?
         বিশাল উঠোন। শানবাঁধানো। মাঝমধ্যিখানে বিরাট ইঁদারা। তোকে বলছিলাম না, ভেতরে না ঢুকলে কল্পনাও করতে পারবি না যে সে কী সুন্দর বাড়ি! সদর দিয়ে ঢুকে বারবাড়ি। লম্বা দালান পেরিয়ে অন্দরমহলউঠোনের চারিধার রেলিং দিয়ে ঘেরা। ঘরের মেঝেগুলো কুচকুচ করছে কালো। আর জানলায় কী যে অদ্ভুত খিলেনের কাজ...
         ইতিমধ্যে অভয় ঘোষ রোডে ঢুকে পড়েছে টোটো। উঁচু উঁচু সাবেক বাড়িগুলোর ছাদ থেকে নেমে আসছিল পৌষসন্ধ্যার ঘন অন্ধকার। অপূর্ব জিজ্ঞাসা করে, তা তোমার পিসির ছেলেমেয়েরা সব কোথায় এখন? বাড়িটাতেই বা কারা থাকে?
         পিসির ছিল দুই ছেলে। দু’জনেই ছিল আমাদের চাইতে বয়েসে অনেক বড়। কেউই বেঁচে নেই আরএক দাদা আবার ছিল নিঃসন্তান। নিজের ভাগের অংশ দিয়ে গিয়েছিল বউদির এক ভাইপোকে। উলটোদিকের বাড়িটাই বউদির বাপের বাড়ি।
         ও, তাহলে তো এখন যারা থাকে সবাইকেই চেনো।
         চিনব না কেন! রাস্তাঘাটে দেখাও হয়েছে কতবার। পার্লারটা দেখলি না? ওটা বউদির ভাইপোবউই করেছে। অনেক বছর পরে একদিন দেখা হয়েছিল অরবিন্দ রোডে। দু’জনেই ঘুরেফিরে তাকাচ্ছি দু’জনের মুখের দিকে। শেষে ওই বলল, চেনা লোক মনে হচ্ছে যেন...
         তাহলে এত চেনাশুনো যখন আছে একদিন তো গিয়ে দেখেই আসতে পারো সব আগের মতন আছে নাকি...
         ধুর। তাই যাওয়া যায়! এখন আর সেই যোগাযোগ আছে! কৃষ্ণনগরে আমাদের আপন পিসির ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বা কী যোগাযোগটা রইল ছোটপিসিমা মারা যাওয়ার পর! তোর দাদুর কাজে বলা হয়েছিল। এসেওছিল ওরাব্যাস। ওখানেই ইতি...
         শুনতে শুনতে চুপ হয়ে গিয়েছিল অপূর্ব। অনেক কথাই বলে যাচ্ছিলেন আলপনা। ছোট-বড় নর্দমাগুলোকে পৌরসভা থেকে ঢেকে দেওয়ায় ইদানীং চেহারাই বদলে গিয়েছে শহরের। গলি থেকে রাজপথ— চওড়ায় বেড়েছে সবাই মিত্রবাগান রোড থেকে ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জি রোডে উঠছিল তিন চাকার মন্থর গাড়িটা। হঠাৎ বলে ওঠে অপূর্ব, জর্জ রোডের স্টেট ব্যাঙ্কের ঠিক উলটোদিকের বাড়িটাকে খেয়াল করেছ কখনও?
         ও তো কুণ্ডুদের বাড়ি...
         ঠিক, ডাকবাক্সের গায়ে কুণ্ডুই লেখা আছে দেখেছি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল জানো...
         কী কথা?
         প্রাইমারিতে পড়ার সময় একটা ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে নাম ভুলে গেছিমুখ দেখলেও চিনতে পারব না আজ আর একদিন সন্ধেবেলা বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলাম জর্জ রোড দিয়ে। তা সেই ছেলেটাকে ওই বাড়িটার মধ্যে দেখেছিলাম সেদিন...
         হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই বাড়ির একটা ছেলে তোর সঙ্গে পড়ত। ওর মা আবার কাত্যায়নীতে এক ক্লাস সিনিয়র ছিল আমার...
         দেখেছ! কেমন মনে আছে! কিন্তু তারপর উঁচু ক্লাসে উঠে আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। প্রথম প্রথম তো মনে ছিল সবইছুটির পর যখন ফিরতাম জর্জ রোড ধরে, বাড়িটার সামনে এলেই মনে হত, কই, আর তো দেখি না সেই বন্ধুটাকে। ভেতরে গিয়ে তার কথা জিজ্ঞাসা করব কিনা ভেবেছি কতদিন...
         দাঁড়া দাঁড়া, ঠিকই বলেছিস। মনে পড়েছে। ওর মা একবার বলেছিল, আমরা চলে যাব এখান থেকে। আমিও তারপর আর স্কুলের গেটে দেখিনি ওর মাকে...
         তাহলেই দ্যাখো। কবেকার কথা। নাম মনে নেই। কেমন দেখতে ছিল ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে এই তিনতলা বাড়িটায় একদিন থাকত একটা ছেলে যে পড়ত আমার সঙ্গে। তোমার রাজা মিয়াঁর বাড়ির কথায় মনে পড়ল এত কথাবোধহয় ঠিকই বলেছ তুমি। মনে পড়লেও আর ফিরে যাওয়া যায় না বাড়িগুলোয়...
         রামকৃষ্ণর চৌমাথায় ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জি রোডের দুটো লেনেই এই মুহূর্তে লাল সিগন্যাল। বরোদা ব্রিজ দিয়ে রেলের ওপার থেকে গাড়িগুলো আসছে শুধু এখন। সামনের রাস্তায় জমেছে সরকারি বাস থেকে প্রাইভেট কার, লড়ঝড়ে অটো থেকে বুলেট মোটরবাইকের ভিড়। দম বন্ধ করে অগত্যা সবার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে টোটোঅনেকক্ষণ একভাবে বসে থেকে এই ফাঁকে একটু নড়েচড়ে নেয় অপূর্ব।
         আলপনা বলেন, তোর দাদু গল্প করত, তেল ফুটে উঠেছে তখন উনুনের আঁচে। এই এত বড়-বড় সাইজের কইমাছ সবে কড়ায় ছেড়েছে আমাদের ফুলমাতোর দাদু ভাবছে চট করে ডুবটা দিয়ে আসবে খিড়কির পুকুর থেকেসেই অবস্থায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল সব রেখেএকটা পোষা কাকাতুয়া ছিল। সেটাকেও সঙ্গে আনার সময় পায়নি। মুসলমানদের মধ্যেই কয়েকজন ছিল বাবার বন্ধুতারা এসে খবর দিয়েছিল, খোকা, এক্ষুনি পালিয়ে যা তোরাএরপর আর বাঁচাতে পারব না আমরা...
         ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জি রোডের লাগোয়া দোকানগুলোয় জ্বলে উঠেছে আলো। সিগন্যাল পেয়ে আবার চলতে শুরু করল দুবলাপাতলা গাড়িটা। ধুতি, বেনারসি, জুতো আর তত্ত্বের প্যাকেটগুলো ডান পা-র ঠেকনোয় রেখে চুপচাপ বসে থাকে অপূর্ব। ডানদিকে বাঁক নিয়ে বরোদা ব্রিজে উঠছিল টোটোটা। পুরনো রামকৃষ্ণ টকির জমিটার দিকে চোখ পড়ে যায় অপূর্বরএই হলে নাকি একদিন এসেছিল কাশ্মীর কি কলি। শাম্মি কাপুরের ছবি মানেই ভূভারতে মারকাটারি হিট সেদিনসেই সিনেমাহল মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে ইদানীং উঠছে হাইরাইজ। পৌষের কনকনে সন্ধ্যা আজ একটু বেশিই স্থবির। নিউ ইয়ার্স ইভে এত জাঁকিয়ে শীত পড়েনি বেশ ক’ বছর। তিন তারিখ সকাল থেকে শুরু হল বৃষ্টি। আজ রবিবার রোদ উঠলেও মাঝেমধ্যেই শিরশিরিয়ে উঠছে হাড়গুলো অবধি
         নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার বলেন আলপনা, ওই বাড়িতে তোর বাবারও এক বন্ধু থাকতশারদ কুণ্ডু...
         তাই নাকি! ওই ছেলেটার কে হত সম্পর্কে?
         বোধহয় জ্যাঠা। খুব অমায়িক লোকঅমিদাদুর কাছে ওষুধ খেতেন। কাটাছেঁড়া ছাড়া অ্যালোপ্যাথিতে যেতেন না। দেখা হয়েছিল একবার আমাদের সঙ্গে। আমরাও ঢুকছি আর উনিও বেরোচ্ছেন ওষুধ নিয়েতোর বাবাকে দেখে একেবারে জড়িয়ে ধরেছিল। কত বছর পরে তোর সঙ্গে দেখা হল রে হরিশ...
         বরোদা ব্রিজের মাথা থেকে দেখা যায় স্টেডিয়ামের হ্যালোজেনগুলোকে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেশ গতি তুলেছে তিন চাকার গাড়িটা। উলের টুপিতে কানমাথা ঢাকা থাকলেও নাক দিয়ে হুহু করে ঢুকছিল হাওয়া। কথা বলতে বলতে গায়ের শালে নাকমাথা মুড়িয়ে নেয় মা।
         দূরের হ্যালোজেনগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল অপূর্ব। লতায়পাতায় বোধহয় থেকেই যায় কিছু না কিছু যোগসূত্র। নইলে পুরনো ক্লাসমেটের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বাড়িটার সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ— এমনটাই তো ভেবে এসেছে গত সাতাশ বছরকে জানত মা-বাবা দুই তরফেই খোলা ছিল আরও দুটো জোরালো সম্পর্কআজ মনে হয়, শহরের যত পোড়োবাড়ি, গরাদের জানলায় টিকে থাকা যত কাঠের খড়খড়ি, বিশ ইঞ্চি পুরু দেয়ালের ফাঁকে জানলা-দরজার মাথা থেকে ঘরের ভেতর উঁকি মারা যত অর্ধচন্দ্রাকার শরদাল, ছাদের তলায় নিঃসাড়ে আজও শ্বাস ফেলা যত কড়িবরগা— অল্প খুঁজলেই তাদের সবার সঙ্গেই পরপর বেরিয়ে পড়বে এমনি বিচিত্র সব যোগাযোগ। অতীতের যেসব অট্টালিকার সঙ্গে নিজেকে একেবারেই সম্পর্কহীন মনে হয় আজকাল, অথচ কারণে-অকারণে বারেবারে চোখ টানে যাদের অস্তিত্ব— হয়তো এভাবেই পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর বছর পিছিয়ে যেতে পারলে খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের সঙ্গে তার আপন পূর্বপুরুষদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আরও পিছোতে থাকলে এভাবেই, সময়ের চাকাকে দু’-এক শতক, দু’-এক সহস্রাব্দ পিছিয়ে নিয়ে গেলে কি অপরিচয় ক্রমে পরিচয়ে, চেনাপরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে, বন্ধুত্ব ক্রমে আত্মীয়তার সূত্রে পালটে যেতে থাকবে না? এভাবেই কি গিয়ে পৌঁছনো সম্ভব সুদূর অতীতে আফ্রিকার অরণ্যের সেই আদি মানবটির শিকড়ে?
         বছর দুই হবে। বামাদার কাছে খোঁজ পেয়ে হাত দেখাতে গিয়েছিল অরুণাংশুকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে শেওড়াফুলিতেলোকটি অশীতিপর, কিন্তু চেহারায় সত্তরের বেশি লাগে না কিছুতেই। হাত দেখার সঙ্গে ছকও বানাতেন ভদ্রলোক। জন্মস্থানের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারা কি বরাবর ওখানকারই বাসিন্দা?
         বলতে পারেন। দুই পুরুষের বসবাস...
         খানিক কথাবার্তার পর আবার প্রশ্ন, কোনদিকটায় বাড়ি তোমাদের?
         রেললাইনের পূর্বদিকে।
         কালীপুজোয় উনতিরিশ হাত উঁচু ঠাকুর হয়, আশেপাশে?
         আর-একটু পুবে এগোতে হবে ওই রাস্তা ধরেই। গেছেন ওদিকে...
         আমি ওই শহরেরই ছেলে।
         তাই নাকি! আপনাদের বাড়িটা কোথায়?
         রেলের এপারে ছিল। হরিদাস ঘোষ রোডেযাইনি অনেক বছর। সে এতদিনে নিয়ে নিয়েছে বাঙালেরা...
         শেষের কথাটায় অল্প হোঁচট লাগলেও হরিদাস ঘোষ রোডের নামে হঠাৎ বসতে হয়েছিল নড়েচড়ে, কোন বাড়িটা বলুন তো। ছোটবেলার বেশিটা কেটেছে ওদিকেইমামার বাড়ি ছিল শাস্ত্রীপাড়ায়। একটা ফ্ল্যাটবাড়ি ছিল আপনাদের ওই রাস্তায়...
         মঞ্জুভিলা। ওর পাশের বাড়িটাই ছিল আমাদের।
         আরে, ওই বাড়িটা, যে সমস্যার সুবাদে যাওয়া হঠাৎ সেসব ভুলে উচ্ছ্বসিত অপূর্ব, অনেকখানি জমি নিয়ে বাড়িটা। দোতলা। বড়-বড় গাছসিঁড়ির পাশে গাড়িবারান্দা...
         ওই বাড়িটাই...
         সামনে বসে থাকা চোখে চশমা আঁটা বিরাশি বছরের মানুষটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অপূর্ব। অনেকদিন আর সেভাবে হরিদাস ঘোষ রোডে যেতে না হলেও বাড়িটাকে মনে ছিল ভালই। লোহার চওড়া ফটক, সদর অবধি চলে যাওয়া ইটবাঁধানো রাস্তা, সিঁড়ির লাগোয়া গাড়িবারান্দা, জমির ঈশানকোনা-ঘেঁষা দোতলা বাড়িটাকে বাদ দিয়ে বাকি এলাকা জুড়ে শুধু বড়-বড় গাছ— ওই রাস্তায় গেলেই চোখ টানত আলাদা করে শৈশবের অনুসন্ধিৎসায় ইচ্ছে হয়েছে কতদিন, খোঁজ করে রহস্যময় বাড়িটায় থাকা লোকজনগুলোরএত বছর পরে এমনি অভাবিত যোগাযোগে মুখে আর কথা সরছিল না সেদিন।
         কাঠগোলা পেরিয়ে পাওয়ার হাউস মোড়ের দিকে ছুটছিল টোটোরাতে একবার ফোন করতে হবে দোকানে। খোঁজ নিতে হবে কার্ড ছেপে এল নাকি। দেরি করছে বড্ড। অনেককিছুতেই দেরি হয়ে যায় তার। এই যেমন দেরি হয়ে গেল খোদ আসল কাজেই। সাঁইতিরিশ ছুঁতে চলেছে বয়সের কাঁটা। সব ঠিকঠাক চললে কাজটা হয়ে যায় দশ বছর আগেই।
আচ্ছা, তখনই যদি হয়ে যেত কাজটা, যারা যারা নিমন্ত্রণ পেত সেদিন, ক’জন বাদ পড়ছে আজ তাদের মধ্যে! বড় আশ্চর্য ধাঁধা সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের এই চড়াই উতরাই। কোনও গোলযোগ ছাড়াই, শেষ সাক্ষাতেও যথেষ্ট উষ্ণতা সত্ত্বেও, যোগাযোগের অভাবেই শুধু মরে যায় কত সম্পর্ক। দাদুর কাজে এসেছিল কৃষ্ণনগরের মাসিরা। কী হল তারপর! কোনও মনোমালিন্য হয়নি। তাও একমাত্র ছেলের বিয়েতে নিজেরই পিসতুতো বোনেদের নেমন্তন্ন করার কথা মাথাতেও আসে না মা-র। যে রাজা মিয়াঁর বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা মানুষের শৈশবের এত মুগ্ধতা, দূর সম্পর্ক হলেও সেই বাড়ির আজকের জ্ঞাতিদের দোরে গিয়ে দাঁড়াতেও তৈরি হয়ে যায় কত অদৃশ্য বাধা। সবই সময়ের খেলা। আবার চল্লিশ বছর আগে মা-র নিজের বিয়েতে হয়তো তিন দিন পাত পেড়ে খেয়ে গিয়েছিল এই মানুষগুলোই। রসিকতা করে হয়তো বলেছিল কেউ কেউ, অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নটা যেন শিগগিরি পাই...
         দুটো মানুষের বিয়ের ভোজে খেয়ে যাওয়া ক’জন নেমন্তন্ন পায় সন্তানের অন্নপ্রাশনে!
         অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রিত মানুষদেরই বা ক’জন ফিরে আসতে পারে পাঁচ বছরের জন্মদিনে!
         জন্মদিনে আমন্ত্রিতদের সকলেই কি ফটোফ্রেমে রয়ে যায় সেই সন্তানের বিবাহ অবধি!
কখন থেকে তাহলে ঠিক ফুরিয়ে যায় একটা সম্পর্ক!
সালতারিখে ধরা যায় সেই মৃত্যুমুহূর্তকে!
আদহাটা রোড ধরে ঢিমেতালে এগোচ্ছিল তিন চাকার গাড়িটা। দেউলপাড়ার বাড়িগুলো তুলনায় সবই নতুন। তিরিশ বছর আগেও অনেক ফাঁকা ছিল এদিকের জমিজায়গাসব ভরে উঠছে ইদানীং। এইসব ঘরবাড়ির ভিড় থেকেও হয়তো একদিন জন্ম হবে কোনও এক কুণ্ডুবাড়ি, কোনও এক রাজা মিয়াঁর বাড়ির। মুখার্জিবাড়ির মতোই অদ্ভুত রহস্যের হাতছানি দিয়ে আজকের কিশোরকেও হয়তো ডাক দেবে এই ভিড়েরই কোন বাড়ি।
শীতের মফস্‌সল শহরের জবুথবু পথঘাটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই আশ্চর্য বইটাকে মনে পড়ে যায় অপূর্বর। একটা আস্ত শহর ধ্বংস হয়ে গেলেও যার বর্ণনা থেকে শুধু সেই শহরের পথঘাট, পয়ঃপ্রণালী, ঘরবাড়িদেরই নয়, বানিয়ে তোলা যেত তার বাসিন্দাদেরও অবিকল।
আসলে সেই শহরটা লুকিয়ে আছে পৃথিবীর যাবতীয় শহরেরই অন্তরমহলে।
পৃথিবীর যে কোনও শহরের মানুষই আসলে সেই শহরটারই বাসিন্দা।
পৌষের কনকনে সন্ধ্যায় মনে হল অপূর্বর।


4 comments:

  1. খুব সুন্দর দাদাভাই😛 sorry mr.অপূর্ব

    ReplyDelete
  2. সুন্দর হয়ছে গল্পটা।

    ReplyDelete
  3. ভালো গল্প । ভাবায় । স্মৃতির প্রক্ষিপ্ত টুকরোগুলো জুড়ে নিয়ে যদি মনরঙা একটা বাস্তব গড়ে নেওয়া যেত তাহলে হয়তো আরও বাসযোগ্য একটা পৃথিবী পেতো অপূর্বর উত্তরপ্রজন্ম ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আশা রাখা যায়, একদিন সেই কাজটা হবে কোনও উত্তরপ্রজন্মের হাতেই

      Delete